ভারত থেকে আজ বৃহস্পতিবার আসছে বহুল প্রতীক্ষিত ভ্যাকসিন, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনার টিকা। প্রথমেই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের তরফে উপহার হিসেবে বাংলাদেশ পাচ্ছে ২০ লাখ ডোজ টিকা। এগুলো আসার পর পরই পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু হবে। প্রথম দিন ২০ থেকে ২৫ জনের ওপর এ টিকা প্রয়োগ করা হবে। এর পর রাজধানীর চারটি হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপরও প্রয়োগ করা হবে এবং রাখা হবে এক সপ্তাহের পর্যবেক্ষণে। সেই পর্যবেক্ষণে ইতিবাচক সংকেত পাওয়া গেলে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই দেশব্যাপী শুরু হয়ে যাবে টিকাদান কর্মসূচি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম বলেন, কোভিড চলাকালীন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে যেভাবে স্বাস্থ্য বুলেটিন প্রচার করা হয়েছে, একইভাবে কোভিড ভ্যাকসিন প্রদানের সব তথ্য মানুষের কাছে দ্রুততার সঙ্গে পৌঁছে দিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে নিয়মিত ভ্যাকসিন বুলেটিন প্রচারের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। স্বাস্থ্য সচিব মো. আবদুল মান্নান গতকাল আয়োজিত এ সংক্রান্ত সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, টিকাদানের জন্য একটা সম্ভাব্য দিন ঠিক করা আছে- ২৭ বা ২৮ জানুয়ারি। ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল থেকে শুরু হবে এর কার্যক্রম। প্রথম দিন চিকিৎসক, নার্স, বীর মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক, পুলিশ, সেনাবাহিনী, প্রশাসন, সাংবাদিকদের একজন
করে প্রতিনিধিকে টিকা দেওয়া হবে। এভাবে সেদিন ২০ থেকে ২৫ জনের ওপর টিকা প্রয়োগ করা হবে। এর পর রাজধানীর কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড চারটি হাসপাতালের ৫শ থেকে ৬শ স্বাস্থ্যকর্মীকে টিকা দিয়ে সাত দিন পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। এর পরই সারাদেশে টিকার প্রয়োগ শুরু হবে। আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি জেলা-উপজেলা এবং মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে টিকা দেওয়া হবে। এটাই প্রাথমিক পরিকল্পনা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তথ্যমতে, ভারত সরকারের কাছ থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া ২০ লাখ ডোজ টিকা পাচ্ছে বাংলাদেশ। আজ বৃহস্পতিবার এই টিকা বাংলাদেশে এসে পৌঁছাবে। এ ছাড়া ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে বেক্সিমকো ফার্মাসিটিউক্যালস লিমিটেডের মাধ্যমে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ৩ কোটি ডোজ কিনেছে বাংলাদেশ সরকার। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসব টিকা গ্রহণ করবেন। এর পর বেলা ১টায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেনের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ২০ লাখ টিকা হস্তান্তর করবেন ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকশিনার বিক্রম দোরাইস্বামী।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হবে। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট পুনে থেকে দিল্লি এয়ারপোর্ট হয়ে টিকা ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছাবে। উপহারের টিকা বিমানবন্দর থেকে মহাখালীর ইপিআই সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হবে পুলিশি মহড়াসহ। টিকা সংরক্ষণে ইপিআই সেন্টার প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সেখান থেকে টিকা দেশের বিভিন্ন জেলার সংরক্ষণ কেন্দ্রে পৌঁছে দেওয়া হবে। এর পরই ভ্যাকসিন কর্মসূচি শুরু করে দেওয়া হবে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়নে সরকার ৭ হাজার ৩৪৪টি ‘দল’ গঠন করেছে। প্রতিটি দলে দুজন নার্স বা পরিবারকল্যাণ পরিদর্শিকা (যারা টিকা দেবেন) ৪ জন স্বেচ্ছাসেবী থাকবেন। অর্থাৎ টিকাদান কর্মসূচি সফল করতে প্রায় ৫০ হাজার কর্মী প্রস্তুত করা হচ্ছে। এ ছাড়া হাসপাতালসহ ঢাকায় আপাতত ৩শ কেন্দ্র থাকবে, যেখানে মানুষ এসে টিকা গ্রহণ করবেন। ঢাকার বাইরে প্রত্যেক জেলায় চারটি, উপজেলায় দুটি এবং মেডিক্যাল কলেজে ছয়টি ‘দল’ টিকা প্রয়োগের কাজে নিয়োজিত থাকবে। প্রাথমিকভাবে ইউনিয়নে টিকা যাবে না। শুধু জেলা, উপজেলা এবং সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রতিদিন প্রায় ২ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়া হবে।
টিকা প্রয়োগসংক্রান্ত পরিকল্পনা নিয়ে গতকাল বুধবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সমন্বয়ক (এসডিজিবিষয়ক) জুয়েনা আজিজের সভাপতিত্বে সভায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের সিনিয়র সচিব এনএম জিয়াউল আলম, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সমন্বয়ক (এসডিজিবিষয়ক) জুয়েনা আজিজ বলেছেন, টিকা দেশে এলে সেটিকে যথাযথ নিরাপত্তার মাধ্যমে বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হবে এবং এটি প্রদানে যেন কোনো প্রকার অনিয়ম না হয়, সে ব্যাপারে সরকার কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা রাখা হবে।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল মান্নান বলেছেন, বাংলাদেশে নতুন করোনা ভাইরাসের টিকাদান কর্মসূচি ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে শুরুর পরিকল্পনা হলেও টিকা আগে পাওয়ায় প্রয়োগের সময়ও এগিয়ে আনা হচ্ছে। আমাদের একটা সম্ভাব্য দিন ঠিক করা আছে ২৭ অথবা ২৮ জানুয়ারি। তবে এটা চূড়ান্ত নয়। প্রথম দিনে ২০ থেকে ২৫ জনের ওপর তা প্রয়োগ করা হবে।
তিনি বলেছেন, টিকা বিতরণের পরিকল্পনা ইতোমধ্যেই চূড়ান্ত করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টিকাদান কর্মসূচি উদ্বোধন করবেন। ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল থেকে উদ্বোধন করার কথা রয়েছে, এটাই প্রাথমিক পরিকল্পনা।
প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ শেষে সারাদেশে টিকা বিতরণ শুরু হবে জানিয়ে সচিব বলেন, সরকারের কেনা টিকা জেলা পর্যায়ে পৌঁছে দেবে বেক্সিমকো। আর ভারত সরকারের উপহার হিসেবে আসা টিকা সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির আওতায় জেলা পর্যায়ে পৌঁছানো হবে।
টিকা সংরক্ষণের বিষয়ে মান্নান বলেন, উপহার হিসেবে পাওয়া টিকা ঢাকায় কোল্ড চেইনে আমরা রাখার চেষ্টা করছি। ঢাকা থেকে বিভিন্ন জেলার সিভিল সার্জনদের কাছে পাঠানো হবে। এটা ইপিআই কর্মসূচির আওতায় যেভাবে টিকা পাঠানো হয়, সেভাবে পৌঁছে দেওয়া হবে। তবে এ পর্যায়ে দেশের বেসরকারি হাসপাতালে করোনার টিকা দেওয়া হবে না।
তিনি, অ্যাস্ট্রাজেনেকার অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন যারা গ্রহণ করেছে, তাদের শারীরিকভাবে বড় কোনো সমস্যা এখনো দেখা দেয়নি। তবে ভ্যাকসিন-পরবর্তী কারও শরীরে কোনো ধরনের পাশর্^প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে তার তাৎক্ষণিক চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য ভ্যাকসিন গ্রহণকারী সবাইকেই টেলিমেডিসিন সেবা দেবে সরকার।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল মান্নান বলেছেন, দেশের অন্তত ৮ থেকে ৯ কোটি মানুষকে যেন টিকা দেওয়া যায়, সেই প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। এতে দেশে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হবে। তিনি বলেন, ভারতের উপহার হিসেবে ২০ লাখ ভ্যাকসিন দেশে আসছে। এর পর আসবে বাংলাদেশের কেনা ৫০ লাখ ভ্যাকসিন। এভাবে ভারত থেকে আরও ৩ কোটি ডোজ টিকা পর্যায়ক্রমে আসবে। এ ছাড়া কোভ্যাক্স থেকে দেশের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ হিসাবে ৬ কোটি ৮০ লাখ ডোজ টিকা আসবে। আর এই ৬ কোটি ৮০ লাখ ডোজ দেওয়া হবে ৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষকে। ভারত কিনে আনা ৩ কোটি ডোজ দেওয়া হবে ১ কোটি ৫০ লাখ মানুষ। সব মিলিয়ে ৪ কোটি ৯০ লাখ মানুষ এই দুই সোর্স থেকে আসা ভ্যাকসিন পাচ্ছে। এর সঙ্গে রয়েছে উপহারের ২০ লাখ। এই হিসাবে মোট জনসংখ্যা হয় ৫ কোটি ১০ লাখ। কিন্তু আমাদের প্রস্তুতি হচ্ছে দেশের ৮ থেকে ৯ কোটি মানুষকে টিকা প্রদানের চেষ্টা করা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বরাত দিয়ে তিনি আরও বলেন, যদি দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়া যায়, তা হলে দেশে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হবে। আমাদের মাইক্রো প্ল্যানে এই ৮০ শতাংশ মানুষকেই টিকা দেওয়ার প্রস্তুতি রয়েছে। দেশের ৫ কোটি ১০ লাখের মানুষকে টিকা দেওয়ার পরও যদি প্রয়োজন হয়, তা হলে আরও টিকা আমদানি করা হবে। একই সঙ্গে আমি অত্যন্ত আশাবাদী, আগামী জুন-জুলাইয়ের মধ্যে আমাদের দেশেই ভ্যাকসিন তৈরি হবে এবং এটা অ্যাভেইলেবেল হয়ে যাবে।
দেশে কোনো নকল ভ্যাকসিন প্রয়োগের সুযোগ আছে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব জানান, দেশের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কঠোর নিয়মের মাধ্যমে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান ছাড়া এই ভ্যাকসিন প্রয়োগের কোনো সুযোগ নেই। এ জন্য সরকার ‘সুরক্ষা অ্যাপ’ নামে একটি সরকারি অ্যাপ থেকেই ভ্যাকসিনের জন্য নাম নিবন্ধনের সুযোগ দিয়েছে। এর ফলে নকল ভ্যাকসিন প্রয়োগের আর কোনো সুযোগ নেই।
প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। গত বছরের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়।