অদ্ভুত এক গুণের মাছ ‘সারপা সালপা’। রূপেরও কমতি নেই, রুপালি আঁশের উপর সোনালি ডোরা। পানির মধ্যে যখন মাছটি সাঁতড়ে বেড়ায়, দেখে মনে হয় রুপার মুদ্রা ছড়িয়ে রয়েছে। ‘সালেমা পর্জি’ নামেও পরিচিত এ মাছ খেলে নাকি নেশা হয়; যার রেশ থাকে প্রায় ৩৬ ঘণ্টা।
আরবিতে সালেমা পর্জিকে বলা হয়, ‘যে মাছ স্বপ্ন দেখায়’। মনে করা হয়, রোমান সম্রাটেরা এই মাছ খেয়ে নেশা, আমোদ করতেন। পলিনেশীয়রা উৎসব-অনুষ্ঠানে এই মাছ খেতেন। আফ্রিকা উপকূল সংলগ্ন আটলান্টিক মহাসাগর এবং ভূমধ্যসাগর এই মাছের বাসস্থান।
প্রথম এই মাছ খেয়ে নেশার কয়েকটি ঘটনা ২০০৬ সালে একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল। সেখানে ১৯৯৪ ফ্রেঞ্চ রিভিয়েরায় বেড়াতে গিয়েছিলেন ৪০ বছরের এক ব্যক্তি। সেখানে এই মাছ সেঁকে খেয়েছিলেন তিনি। খাওয়ার পরের দিনই শুরু হয় বমি, মাথা ঘোরা। চোখে ঝাপসা দেখতে শুরু করেন তিনি। পেশি দুর্বল হয়ে যায়। বাড়ি ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। গাড়িতে চেপে বসেন। কিন্তু বুঝতে পারেন গাড়ি চালাতে পারছেন না। তার কানে চারদিক থেকে পশুর চিৎকার ভেসে আসতে থাকে।
এরপর ওই ব্যক্তি সোজা হাসপাতালে ছোটেন। ভর্তি হয়ে যান সেখানে। প্রায় দু’দিন চিকিৎসার পর সেরে ওঠেন। যদিও কী হয়েছিল তা মনে করতে পারেননি তিনি। ২০০২ সালে ফ্রেঞ্চ রিভিয়েরাতেই একই রকম আরেকটা ঘটনা ঘটে। সেন্ট ট্রোপেজে ওই মাছ কিনে গ্রিল করে খেয়েছিলেন ৯০ বছরের এক ব্যক্তি। মাছটি খাওয়ার পরেই ওই প্রবীণ নানা রকম শব্দ শুনতে থাকেন। কানে আসতে থাকে মানুষের চিৎকার, পাখির কলরব। টানা দু’দিন নানা রকম স্বপ্ন দেখেন তিনি। ভেবেছিলেন মানসিক সমস্যা হয়েছে তার।
সামুদ্রিক প্রাণীবিদ ক্যাথরিন জাদো সমুদ্রের মাছ নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, সালেমা পর্জি খেলে মানুষের স্নায়ুতন্ত্রকে প্রভাবিত করতে পারে। এলএসডি খেলে যেমন নেশা হয়, এই মাছ খেলেও তেমন হতে পারে। অনেক বিজ্ঞানীই আবার মনে করেন, এই মাছ খেলে সকলের যে নেশা হবে, তা নয়। অনেকেরই শরীরে এই মাছের কোনো প্রভাব পড়ে না। যদি সকলেরই নেশা হতো, তা হলে এই দিয়ে মাদক তৈরি হতো।
কেন এই মাছ খেলে কারও কারও নেশা হয়- এ নিয়ে ২০১২ সালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে এই মাছের খাদ্যাভ্যাসকে দায়ী করা হয়। এই মাছ ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন জাতীয় অ্যালগি খায়। যা থাকে পসিডোনিয়া ওশিয়ানিয়া নামের সামুদ্রিক ঘাসে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই অ্যালগির প্রভাবে সালেমা পর্জির শরীরে টক্সিন তৈরি হয়। তবে মাছটির শরীরে কী ধরনের টক্সিন তৈরি হয়, তা স্পষ্ট নয় বিজ্ঞানীদের কাছে। কেউ মনে করেন সালেমা পর্জির শরীরে ইন্ডোল গোষ্ঠীর ক্ষার থাকে। এলএসডির গঠনও এ রকমই।
অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন সালেমা পর্জির শরীরে ডিমেথলাইট্রাইপথামিন (ডিএমটি) থাকে। এটি এক ধরনের মাদক জাতীয় পদার্থ, যা অনেক জীবেই থাকে। গবেষকদের মতে, এই ডিএমটির কারণে এই মাছ খেলে নেশা হতে পারে। তবে কী থেকে আসলে নেশা হয়, তা নিয়ে বিশেষ গবেষণা হয়নি।
কয়েকজন বিজ্ঞানীর দাবি, এই মাছের মাথা না খেলে নেশা হয় না। মাথা ছাড়া মাছ মরিচ আর লেবু দিয়ে সেঁকে অনেকেই খেয়ে থাকেন। তবে কার কখন নেশা হতে পারে, তার উত্তর নেই। তবে অনেকেই মনে করেন, কোন সময় এই মাছ ধরা হয়েছে, তার উপর নির্ভর করে তা খেলে কতটা নেশা হবে।
একদল বিজ্ঞানী মনে করেন, শরৎকালে এই মাছে টক্সিসিটি সবচেয়ে বেশি থাকে। তখন এই মাছ খেলে নেশা হতে বাধ্য। যদিও এই মাছ খেয়ে নেশা হওয়ার যত ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে, তা সবই বসন্তের শেষে এবং গ্রীষ্মে। যদিও সালেমা পর্জি নিয়ে এখনও অনেক প্রশ্নের জবাব মেলেনি। সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা।