1. [email protected] : admin :
  2. [email protected] : জাতীয় অর্থনীতি : জাতীয় অর্থনীতি
মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৪৭ পূর্বাহ্ন

অনিয়মে ডুবছে হামদর্দ

রিপোর্টার
  • আপডেট : রবিবার, ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

হাজার কোটি টাকা মূলধনের প্রতিষ্ঠান হামদর্দ ল্যাবরেটরিজ (ওয়াক্ফ) দুর্নীতি, অনিয়ম আর পরিবারতন্ত্রের বেড়াজালে ডুবতে বসেছে। ওয়াক্ফ আইনের তোয়াক্কা না করে প্রতিষ্ঠানটিতে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও পদ ধরে রাখার জোরালো অভিযোগ উঠেছে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাকিম মো. ইউছুফ হারুন ভুইয়া এবং গুরুত্বপূর্ণ আরও তিন পদে আসীন আছেন তাঁর তিন সন্তান।

অভিযোগ রয়েছে- হামদর্দের গুরুত্বপূর্ণ পদ ব্যবহার করে গোপন টেন্ডারের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার কাঁচামাল আমদানি, মেশিন ও যন্ত্রপাতি কেনা, জমি কেনা, কনস্ট্রাকশন, কেমিক্যাল কেনা, ক্যালেন্ডার-ডায়েরি প্রিন্টিং ও প্রকাশনা খাতে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। এ ছাড়া বয়স জালিয়াতি করে ইউছুফ হারুন ভুইয়া হামদর্দ ল্যাবরেটরিজের (ওয়াক্ফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ ধরে রেখেছেন বছরের পর বছর। শ্রমিক-কর্মচারীদের কল্যাণ তহবিলের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং নানা অনিয়মের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পৃথক অনুসন্ধান শুরু করে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ‘হামদর্দ ল্যাবরেটরিজ (ওয়াক্ফ) বাংলাদেশ’ একটি ইউনানি ওয়াক্ফ প্রতিষ্ঠা“ যা অন্যান্য ওয়াক্ফ প্রতিষ্ঠান থেকে ভিন্ন। কারণ অন্যান্য ওয়াক্ফ প্রতিষ্ঠান মসজিদ, মাদরাসা ও জমি বিষয়ক। আর হামদর্দ হলো ব্যবসায়িক, যা ইউনানি ওষুধ তৈরি ও বিক্রি করা নিয়ে। এ প্রতিষ্ঠান একটি ট্রাস্টিও। এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক অন্যান্য বাণিজ্যিক ওয়াক্ফ কিংবা ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠানের মতোই। ২০১২ সালে একটি গেজেটে ইউছুফ হারুন ভুইয়াকে আজীবন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ঘোষণা করে তৎকালীন ওয়াক্ফ প্রশাসক, যা তৎকালীন ওয়াক্ফ প্রশাসকের এখতিয়ার-বহির্ভূত। ওয়াক্ফ প্রশাসক ওয়াক্ফ প্রতিষ্ঠানের মোতাওয়াল্লি নিয়োগ করবে। কিন্তু কাউকে আজীবন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগদানের বিধান নেই। ২০১৩ সালের ওয়াক্ফ বিশেষ বিধান আইনেও আজীবন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের কোনো সুযোগ দেওয়া নেই। এ ছাড়া হামদর্দ ল্যাবরেটরিজে (ওয়াক্ফ) বাংলাদেশের চাকরিবিধি মোতাবেক ৬০ বছরের বেশি বয়সী কারও চাকরি করার সুযোগ নেই। প্রতারণা ও তথ্য গোপনের পরও ইউছুফ হারুনের বয়স দাঁড়িয়েছে ৬৮ বছরে। প্রকৃতপক্ষে তাঁর বয়স ৮০ কিংবা ৮২ বছর বলে জানা গেছে।

 

এসব তথ্য বিশ্লেষণে হাকিম মো. ইউছুফ হারুন ভুইয়ার অবৈধভাবে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ও বিভিন্ন অনিয়মের চিত্র ফুটে ওঠে।

বয়স নিয়ে প্রতারণা : জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যানুযায়ী হাকিম মো. ইউছুফ হারুন ভুইয়ার জন্ম ১৯৫৩ সালের ১ মার্চ। ১৯৭২ সালে তিনি হামদর্দের গুলিস্তান শাখায় ১৭০ টাকা বেতনে কাউন্টার সেলসম্যান হিসেবে যোগদান করেন। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী তখন তাঁর বয়স দাঁড়ায় ১৮ কিংবা ১৯ বছর, যা সত্য নয় বলে অভিযোগ রয়েছে। কারণ এর আগে তিনি পাকিস্তান আমলে আলিয়া মাদরাসা থেকে টাইটেল (মাস্টার্স) পাস করে পাকিস্তান পুলিশের দারোগা হিসেবে চাকরি করেছিলেন। ১৯৭১ সালে দারোগা পদে তাঁর নিয়োগ ছিল অস্থায়ী এবং তিনি ওই সময় স্বাধীনতাবিরোধীদের ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করেছেন। এসব হিসাব করে দেখা যায়, ১৯৭২ সালে হামদর্দে যোগ দেওয়ার সময় তাঁর বয়স কোনো অবস্থাতেই ১৮ কিংবা ১৯ বছর ছিল না। ভুয়া শিক্ষাগত সনদপত্র দিয়ে করেছেন জাতীয় পরিচয়পত্র।

বিতর্কিত নারীকে বিয়ে ও তাঁকে প্রচুর অর্থ-সম্পদ প্রদান : আগের স্বামীর তালাক ছাড়াই বিতর্কিত এক নারীকে বিয়ে করেছেন ইউছুফ হারুন ভুইয়া। ওই নারী হলেন কামরুন নাহার পলিন। তাঁর বাবা আবদুল আউয়াল ভূঁঞা। তাঁর জন্ম ১৯৮০ সালের ৩ মার্চ। তাঁর প্রথম স্বামী শফি উল্লাহ ভূঁঞা। পরে নাজিম উদ্দিন রিপন নামে একজনকে বিয়ে করেন। এরপর আগের স্বামীর নাম বাদ দিয়ে রিপনকে স্বামী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনের আবেদন করেন। এ নাজিম উদ্দিন রিপনের সঙ্গে তালাক হয়নি কামরুন নাহার পলিনের। আর আগের স্বামীর সঙ্গে তালাক না হওয়া কামরুন নাহার পলিনকে বিয়ে করেন ইউছুফ হারুন ভুইয়া। এ ঘটনায় ২০১৯ সালের ১৬ মে লক্ষ্মীপুরের আদালতে মামলা করেন রিপন। মামলায় ইউছুফ হারুন ও কামরুন নাহার পলিনকে আসামি করা হয়।

কর্মচারীদের কল্যাণ তহবিল আত্মসাৎ : ১৯৯৮ সালে হামদর্দে কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারীদের নিয়ে একটি কল্যাণ তহবিল গঠন করা হয়। মূল বেতনের ৫ শতাংশ ওই তহবিলের জন্য কেটে রাখা হতো। এ তহবিল থেকে অবসরকালীন লভ্যাংশ না দিয়ে প্রত্যেককে একটি করে আবাসিক প্লট দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে টাকাও ইউছুফ হারুনের ছত্রচ্ছায়ায় আত্মসাৎ হয়েছে বলে পৃথক দুটি তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

শ্রমিক-কর্মচারীদের প্লটের জন্য নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার পিরোজপুর ও দুধঘাটা মৌজায় ২০৫ বিঘা জমি কেনা হয়। ওইসব জমি কেনায় প্রতারণা ও ব্যাপক জালিয়াতির ঘটনায় ২০২০ সালের ২২ জুন ও ৩০ জুন ওই দুটি প্রতিবেদন দাখিল করেন মেজর (অব.) ইকবাল মাহমুদ চৌধুরী। তাঁর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়- কেনা জমিগুলো নিষ্কণ্টক নয় এবং এর দায়দায়িত্ব প্রতিষ্ঠানের হিসাব শাখা ও প্রতিষ্ঠানের ওপর বর্তায়। অর্থাৎ ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ওপর বর্তায়। জমি কেনার সঠিক কোনো বিল-ভাউচারও নেই। সূত্র জানান, এসব জমির দলিল কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে হয়নি। সরাসরি শ্রমিক-কর্মচারী কল্যাণ তহবিলের (ফান্ড) নামে দলিল করা হয়েছে। অথচ ফান্ডের নামে কিংবা অনিবন্ধিত কোনো প্রতিষ্ঠানের নামেও দলিল হয় না। ২৩৭টি করা দলিল সম্পূর্ণ ভুয়া ও জাল। এ পর্যন্ত কোনো শ্রমিক বা কর্মচারীকে প্লট দেওয়া হয়নি। অথচ যে দুটি মৌজায় শ্রমিক ও কর্মচারীদের প্লটের জায়গা রাখার কথা, সেখানে ইউছুফ হারুন তাঁর ব্যক্তিগত এবং পরিবারের সদস্যদের নামে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি করেছেন। এসব সম্পদ শ্রমিকদের টাকায় কেনা বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

অঢেল সম্পদের মালিক হাকিম ইউছুফ : হামদর্দের টাকায় হাকিম ইউছুফ হারুন আজ ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও লক্ষ্মীপুরে জমি, ভবন ও একাধিক ফ্ল্যাটের মালিক। নারায়ণগঞ্জে (১১৬ মনোহর খাঁর বাগ, মদনপুর, বন্দর থানা) ৭ বিঘা জমিতে রয়েছে ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক কারখানা। ঢাকা থেকে মেঘনাঘাট যেতে মুগড়াপাড়ার কিছু দূরে নয়াগাঁয়ে নদীর ধারে আছে ১৭ বিঘা উঁচু জমি। লক্ষ্মীপুরের দত্তপাড়ায় ৩০ বিঘা জমিতে আছে বিশাল অট্টালিকা, মসজিদ, মাদরাসা ও কলেজ। লক্ষ্মীপুরের চরমুটিয়ায় ৬০ বিঘা জমিতে গড়ে তুলেছেন মাদরাসা। মাদরাসা শিক্ষার আড়ালে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় বলে অভিযোগ এলাকাবাসী ও স্থানীয় প্রশাসনের। এ ছাড়া হামদর্দের টাকায় প্রতিষ্ঠা করেছেন মায়ের নামে রওশন জাহান ইউনানি মেডিকেল কলেজ। ঢাকায় প্রত্যেক ছেলেমেয়ের নামে একাধিক ফ্ল্যাট আছে। বনানী ন্যাম ভবনে (হোল্ডিং ২বি, ফ্ল্যাট-বি৩, ব্লক-আই, রোড-১) হাকিম ইউছুফের নিজের নামেও রয়েছে একাধিক ফ্ল্যাট। সেগুনবাগিচায় (৬৭৫ পাইওনিয়ার রোডে) ৮ কাঠা জমির ওপর আছে আরও একটি বাড়ি।

হামদর্দে জামায়াত-শিবিরের লোকদের নিয়োগ : স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির ঘনিষ্ঠ হাকিম মো. ইউছুফ হারুন হামদর্দে একের পর এক জামায়াত-শিবিরের লোকজনকে নিয়োগ দিচ্ছেন। আর কৌশলে সরিয়ে দিচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। হামদর্দের তথ্য ও গণসংযোগ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক করেছেন আমিরুল মোমেনীন মানিককে। মানিক সাবেক শিবির নেতা। শিবির পরিচালিত সমন্বিত সাংস্কৃতিক সংসদ (সসাস)-এর শিল্পী ও বিতর্কিত ইউটিউব চ্যানেল change tv-এর প্রধান, যার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হয়। শিবিরের কেন্দ্রীয় সম্মেলনে তার গাওয়া গানের ভিডিওগুলো এখনো ইউটিউবে পাওয়া যায়। হামদর্দের উপপরিচালক মিজানুর রহমান সরকারি আলিয়া মাদরাসার সাবেক শিবির ক্যাডার। সম্প্রতি জামায়াতের একনিষ্ঠ কর্মী আবদুল মজিদ খানকে কোম্পানি সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যিনি জামায়াতের রুকন ডা. আনোয়ারুল আজিমের সহযোদ্ধা। এ ছাড়া জামায়াত-শিবিরের বহু লোক হমদর্দের বিভিন্ন পদে কর্মরত।

খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, ভারত-পাকিস্তান হামদর্দেও ৬০ বছরের বেশি কারও চাকরির সুযোগ নেই। সেখানে একই ব্যক্তির আজীবন মোতাওয়াল্লি ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকারও নজির নেই।

Please Share This Post in Your Social Media

এই বিভাগের আরো সংবাদ
© ২০২০ দৈনিক জাতীয় অর্থনীতি