সম্প্রতি ভুল চিকিৎসায় বেশ কয়েকটি মৃত্যুর ঘটনায় সারা দেশের মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। রাজধানীর বাড্ডায় অবস্থিত ইউনাইটেড মেডিকেল হাসপাতালে সুন্নতে খতনা করাতে গিয়ে ৩১ ডিসেম্বর ভর্তি করা হয়েছিল ৫ বছরের শিশু আয়ানকে। চিকিৎসকরা শিশুটির ওপর ভুল অ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগ করে। এতে তার মৃত্যু হয়। এরপরও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মৃত শিশুকে আইসিইউতে রেখে ৬ লাখ টাকা বিল করে। টাকার জন্য শিশুটির পরিবারকে চাপ দিতে থাকে। এমন মর্মান্তিক ঘটনা অনুসন্ধানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পরিদর্শনে যায়। পরে তারা জানায়, অনুমোদন ছাড়াই কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল ইউনাইটেড হাসপাতাল। এমনকি হাসপাতালটি কখনো নিবন্ধনের জন্য আবেদনই করেনি। নির্মাণাধীন ভবনে চিকিৎসাসেবা পরিচালনা করছিল। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র, মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, হাসপাতালের অর্গানোগ্রাম বা জনবলের তালিকাও পাওয়া যায়নি।
কোথাও প্রশাসনের উদাসীনতা আবার কোথাও পরস্পর যোগসাজশ-এভাবে দেশজুড়ে দেদারসে চলছে হাজার হাজার অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ব্ল্যাডব্যাংক। ঢাকার বাইরে বিভাগীয় শহর ও জেলা-উপজেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবার নামে চলছে অমানবিক চিকিৎসা বাণিজ্য। তাদের ধরার জন্য নিয়মিত কোনো অভিযানও নেই। অনুমোদন না নিয়ে অবৈধভাবে সারা দেশে কী পরিমাণ হাসপাতাল ও ক্লিনিক কার্যক্রম চালাচ্ছে সেই তথ্য নেই খোদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছেও। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দেশের মানুষকে আতঙ্কে রাখতে পারে না। তাদের উচিত দেশে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় কতগুলো হাসপাতাল-ক্লিনিক কী ধরনের সেবা দিচ্ছে তার সঠিক তথ্য জনগণকে জানানো। যাতে তারা প্রতারিত না হয়।
জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, মাঠ পর্যায়ে নজরদারি না থাকায় এই অরাজকতা তৈরি হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তর কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিকে সেবার নামে ধোঁকা খাচ্ছে চিকিৎসা নিতে আসা ভুক্তভোগীরা। তাদের ভুল চিকিৎসার শিকার হচ্ছেন রোগীরা। চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হতে গিয়ে উলটো লাশ হয়ে ফিরতে হচ্ছ অনেককেই।
ঢাকার বাইরে সারা দেশেই ভুল চিকিৎসায় রোগী মৃত্যুর মিছিলে নতুন নতুন নাম যুক্ত হচ্ছে। বরগুনার বামনা উপজেলায় সুন্দরবন হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সোমবার রাতে সিজারিয়ান অস্ত্রোপচারের সময় ভুল চিকিৎসায় প্রসূতি মেঘলা আক্তার ও নবজাতকের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় মামলার পর ওই হাসপাতালটি সাময়িকভাবে বন্ধ করা হয়।
একইভাবে গত ৪ জানুয়ারি পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার পৌর এলাকার আলো জেনারেল হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় প্রসূতি অন্তরা খাতুন ও তার নবজাতক সন্তানের মৃত্যু হয়। অন্তরার স্বামী ফজলে রাব্বি যুগান্তরকে বলেন, চিকিৎসক তার প্রসূতি স্ত্রীকে সঠিক নিয়মে অ্যানেস্থেসিয়া না দেওয়ায় স্ত্রী ও নবজাতক সন্তান মারা গেল। জানা গেছে, হাসপাতালটি সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করেছে জেলা সিভিল সার্জন।
এসব ঘটনা সরকারকেও বিচলিত করেছে। বিষয়টি গড়িয়েছে উচ্চ আদালত পর্যন্ত। আদালতের নির্দেশে ঘুম ভেঙেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। দেশে কত হাসপাতাল অবৈধভাবে চলছে তার সঠিক তালিকা তৈরির জন্য তোড়জোড় শুরু হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকার বাইরে রংপুর বিভাগের ৮ জেলায় ৫০৩টি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের মধ্যে অর্ধেকেরই অনুমোদন নেই। এছাড়া ৮২৭টি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মধ্যে ২৮১টি এবং ৯টি ব্ল্যাডব্যাংকের চারটিরই অনুমোদন নেই। গত এক বছরে রংপুরে ৪৪৩টি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে জানান রংপুর বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. এবিএম, হানিফ।
এদিকে ইউনাইটেড হাসপাতালে শিশুমৃত্যুর ঘটনার পর ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে ওই মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ ছাড়া সারা দেশে লাইসেন্স ও অনুমোদনহীন হাসপাতালের তালিকা তৈরি করে তিন মাসের মধ্যে তা জমা দিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
এদিকে মঙ্গলবার সচিবালয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেনের সঙ্গে দেখা করে বিচার চান আয়ানের পরিবারের সদস্যরা। তারা ছেলের মৃত্যুর ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি দাবি করেন। এ সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, বিষয়টি তিনি জেনেছেন। আইন অনুযায়ী সব ধরনের ব্যবস্থা নেবেন। তিনি বলেন, ‘আমি বলেছি দুর্নীতির ব্যাপারে ছাড় দেব না। অননুমোদিত বা লাইসেন্স ছাড়া কোনো হাসপাতাল চলতে দেওয়া হবে না। আমার মেসেজ হচ্ছে, অবৈধ ক্লিনিক, হাসপাতাল বন্ধ করে দেওয় হবে। তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মন্ত্রী বলেন, এগুলোর জন্য আমি নিজেও ভুক্তভোগী।’
সূত্র জানায়, সারা দেশে নিবন্ধনকৃত বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ব্ল্যাডব্যাংকের সংখ্যা প্রায় ৩৫ হাজারের মতো। এর মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান একাধিকবার নিবন্ধন করেছে। অনেকে নিবন্ধন নম্বর নিলেও প্রতিষ্ঠান আলোর মুখ দেখেনি। অথচ চিকিৎসা কার্যক্রম চালাচ্ছে। সোমবার পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে লাইসেন্সধারী বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ব্ল্যাডব্যাংকের সংখ্যা ১৫ হাজার ১৪৩টি। এর মধ্যে ব্ল্যাডব্যাংক ১৯৪টি, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ৯ হাজার ৯৫৬টি এবং ৪ হাজার ৯৯৩টি হাসপাতাল রয়েছে। এর বাইরে যেসব প্রতিষ্ঠান চিকিৎসার নামে ব্যবসা করছে তাদের কারও লাইসেন্স প্রক্রিয়াধীন, কারও লাইসেন্স সাসপেন্ড (স্থগিত) অবস্থায় রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসাপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, ‘সারা দেশে নিবন্ধনের বাইরে কতটি হাসপাতাল ও ক্লিনিক রয়েছে এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। লাইসেন্সের জন্য আবেদনের আগমুহূর্ত পর্যন্ত আমরা জানতে পারি না সেটি বৈধ না অবৈধভাবে চলছে। আবার বৈধতা যাচাইয়ে অধিদপ্তরের নিজস্ব জনবল (আইনশৃঙ্খলা বাহিনী) বা তেমন কিছু নেই। এ অবস্থায় স্বাস্থ্য বিভাগের সব বিভাগীয় পরিচালক ও সিভিল সার্জনকে আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে দেশের সব বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ব্ল্যাডব্যাংকের তথ্য দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৯৮২ সালের মেডিকেল অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস অ্যান্ড ল্যাবরেটরিস অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া কোনো হাসপাতাল, ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার চালানোর সুযোগ নেই। কিন্তু বৈধ-অবৈধ অনেক হাসপাতালে প্রায়ই ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু হচ্ছে।
এর আগে করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে ঢাকার রিজেন্ট হাসপাতালে চিকিৎসার নামে প্রতারণা ও জালিয়াতির ঘটনা সামনে আসে। ওই সময় জানা গিয়েছিল, অনুমোদন ছাড়াই চলছিল হাসপাতালটি। ২০২০ সালের নভেম্বরে ঢাকার আদাবরের মাইন্ড এইড হাসপাতালে এক সহকারী পুলিশ কমিশনারকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার পর জানা যায়, ওই হাসপাতালও সেবা দেওয়ার অনুমোদন পায়নি।
এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালের ২৫ মে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সারা দেশে অনুমোদিত এবং অনুমোদনহীন বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের তালিকা পাঠাতে বিভাগীয় পরিচালকদের নির্দেশ দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। বিভাগীয় কার্যালয়গুলো পাঠানো তথ্য নিয়ে লাইসেন্সবিহীন ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারের একটি তালিকা তৈরি করে অধিদপ্তর। ওই তালিকায় সারা দেশের ১১ হাজার ৯৪০টি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নাম আসে। এগুলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন এবং যথাযথ সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছিল।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সে সময় বলেছিল, ওই তালিকার মধ্যে ২ হাজার ৯১৬টি হাসপাতাল ও ক্লিনিক লাইসেন্সের জন্য কোনো আবেদনই করেনি। ৯ হাজার ২৪টি হাসপাতাল-ক্লিনিকের মধ্যে কোনো কোনোটি লাইসেন্সের জন্য আবেদন করে চিকিৎসা দেওয়া শুরু করলেও এখনো অনুমোদন পায়নি। আবার কোনোটির লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, সেই অর্থে সেগুলোও অবৈধ।
জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল যুগান্তরকে বলেন, একটি হাসপাতাল পরিচালনার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বৈধ সনদ, নিয়মিত নবায়ন, নারকোটিক পারমিট (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), পরিবেশ ছাড়পত্র, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা (ক্ষতিকর ও অক্ষতিকর) কাগজপত্র সত্যায়িত করে সংরক্ষণ করতে হবে। যা পরিদর্শনকালে নিরীক্ষা করতে হবে। বিশেষ সেবার ক্ষেত্রে প্রতিটার শয্যা সংখ্যা, সেবা প্রদানকারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, কর্তব্যরত চিকিৎসকের নাম ও কর্তব্যরত নার্সদের নাম-ঠিকানা, ছবি, বিএমডিসি রেজিস্ট্রেশন, বিশেষজ্ঞ সনদ, নিয়োগ ও যোগদান বা সম্মতিপত্র লাগবে। চিকিৎসা সাহায্যকারীদের তালিকা, যন্ত্রপাতির তালিকা, বর্তমানে যেসব অস্ত্রোপচার ও যন্ত্রপাতির তালিকা হাসপাতালের প্রধানের স্বাক্ষরসহ সংরক্ষণ করতে হবে। কিন্তু কোনো হাসপাতালেই এসব শর্ত শতভাগ মানা হচ্ছে না।