1. [email protected] : admin :
  2. [email protected] : জাতীয় অর্থনীতি : জাতীয় অর্থনীতি
শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৩০ পূর্বাহ্ন

অভ্যুত্থানের পর চাপের মুখে মিয়ানমার সেনাবাহিনী

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
  • আপডেট : বৃহস্পতিবার, ১১ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

প্রায় দু’সপ্তাহ আগে মিয়ানমারে বেসামরিক সরকারকে সরিয়ে সেনাবাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করে। কিন্তু সাধারণ জনগণ সামরিক সরকারের পক্ষে নয়। সেনাবাহিনী যেন নির্বাচনে জয়ী হওয়া বেসামরিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে সেজন্য প্রায় এক সপ্তাহ ধরে রাজপথে বিক্ষোভ-সমাবেশ করছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
দেশব্যাপী যে বিক্ষোভ চলছে তা নিয়ন্ত্রণ করা দেশটির কমান্ডার ইন চিফের জন্য কঠিনই বটে। চলতি মাসের ১ তারিখে দেশটির ক্ষমতাসীন দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) প্রধান অং সান সু চি, দেশটির প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টসহ বেশ কয়েকজনকে আটক করেই দেশের ক্ষমতা গ্রহণ করা হয়। এর কয়েকদিন পরেই সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করে সাধারণ মানুষ।
সেনাবাহিনী ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে সারাদিনব্যাপী রাজপথে সাধারণ মানুষ যেমন বিক্ষোভ করেছে, রাতেও তাদের বিক্ষোভ থামেনি। ইয়াঙ্গুনসহ কয়েকটি নগরীর অধিবাসীরা তাদের বাড়ি থেকে রাতেও বিক্ষোভ করেছেন। তারা ‘অমঙ্গল দূর হবে’ শ্লোগান দিয়ে রীতি অনুযায়ী হাঁড়ি-পাতিল বাজিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। প্রায় প্রতিরাতেই এই চিত্র দেখা যাচ্ছে।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টার দিকে প্রথম জাতির উদ্দেশে টেলিভিশনে ভাষণ দেন সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং। তিনি দেশের জনগণ এবং বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করতে বক্তব্য রাখেন। অনেকেই ওই ভাষণের সময় নিজেদের টেলিভিশনে সেনা প্রধানের মুখে জুতার বাড়ি মেরেছেন। যারা সে সময় হাড়ি-পাতিল বাজিয়ে বিক্ষোভ করেননি বা সেনাপ্রধানকে জুতা মারেননি তারা হয়তো তার সেই ভাষণ শুনতে পেয়েছেন।
তিনি ঘোষণা দিয়েছেন যে, সরকারের কোনো নীতিমালায় বদল আসছে না। এক বছর পর নির্বাচনের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন তিনি। একই সঙ্গে তার নেতৃত্বে এই অন্তবর্তীকালীন সরকার জান্তা সরকারের চেয়ে আলাদা হবে বলেও আশ্বস্ত করেছেন এই সেনাপ্রধান।
মিয়ানমারে ১৯৬২ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে সেনাবাহিনী প্রায় ৫০ বছর ধরে সরাসরি দেশ শাসন করেছে এবং বছরের পর বছর ধরে গণতন্ত্রপন্থি আন্দোলন কঠোরহাতে দমন করেছে। কিন্তু এবার জেনারেল মিন অং হ্লাইং খুব দ্রুতই নতুন নির্বাচনের মাধ্যমে জয়ীদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
নতুন একটি নির্বাচন কমিশন গঠনের কথাও বলেছেন তিনি। জেনারেল হ্লাইং বলেন, ২০১১ সাল পর্যন্ত ৪৯ বছর ধরে মিয়ানমারে যে সেনাশাসন চলেছে তার অধীনে সবকিছু অনেক আলাদা হবে।
তিনি মিয়ানমারে সত্যিকার ‘সুশৃঙ্খল গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। সেনাবাহিনী সম্প্রতি ক্ষমতা গ্রহণের আগে মাঝের প্রায় ১০ বছর দেশটিতে বেসামরিক সরকার দেশ পরিচালনা করেছে। কিন্তু সে সময়ও বেসামরিক সরকার পুরোপুরি স্বাধীন ছিল না। সেখানেও কর্তৃত্ব বজায় রেখেছে সেনাবাহিনী।
সাধারণ মানুষকে কথার ফুলঝুড়িতে আটকে রাখতে পারেননি সেনাপ্রধান হ্লাইং। তার কথায় মানুষ বিক্ষোভ বন্ধ করেনি। ট্রু নিউজ ইনফরমেশন নামে সেনাবাহিনীর একটি টিম লোকজনকে সতর্ক করেছিল যে, কেউ কোনো অন্যায় করলে বা দেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু এই ঘোষণা সাধারণ মানুষ গুরুত্ব দেয়নি।
হাজার হাজার মানুষ রাজধানী নেপিদোসহ বিভিন্ন ছোট-বড় শহরে বিক্ষোভ করেছে। গত ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভ এখনও চলছেই। তারা ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) প্রধান অং সান সু চির মুক্তি দাবি করে আসছে।
গত বছরের নভেম্বরের নির্বাচনে অং সান সুচির এনএলডি সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। নির্বাচনে জয়ী হয়ে তার দলের সরকার গঠনের কথা থাকলেও সেনাবাহিনী তা আটকে দিয়েছে। নির্বাচনের পর থেকেই সেনাবাহিনী জালিয়াতির অভিযোগ করে আসছে। এই অভিযোগ এনেই মূলত ক্ষমতা দখলের সাফাই গেয়ে আসছে সেনাবাহিনী। কিন্তু ভোট জালিয়াতির কোনো প্রমাণ তারা দেখাতে পারেনি। দেশটিতে আগামী এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থাও জারি করা হয়েছে।
গত ১০ ফেব্রুয়ারি অনেক তরুণী ডিজনি প্রিন্সেসের পোশাকে ইয়াঙ্গুনের চারপাশে প্যারেডে অংশ নিয়েছেন। অন্য একটি গ্রুপকে কফিন হাতে সমাবেশ করতে দেখা গেছে। ওই কফিনে সেনাপ্রধানের ছবি লাগানো ছিল। এছাড়া কিছু তরুণ আন্দোলনকারীদের হাতে থাকা প্ল্যাকার্ড ছিল গতানুগতিক ধারার বাইরের, যা ভিন্ন বার্তা দিয়েছে।
যেমন, একজন বিক্ষোভকারীর হাতে থাকা প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘আমার সাবেক প্রেমিক খারাপ তবে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী আরও খারাপ।’ অন্যদিকে আরেকজনের হাতে দেখা গেছে ‘আমি স্বৈরশাসন চাই না, আমি কেবল প্রেমিক চাই’ লেখা প্ল্যাকার্ড।
অন্য বিক্ষোভকারীরা অভ্যুত্থান প্রত্যাখ্যানের ক্ষেত্রে আরও স্পষ্টভাবে বার্তা দিয়েছেন। সেরকম একজনের প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘সেনাবাহিনী ভুল লোকদের সঙ্গে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ আরেক বিক্ষোভকারীর হাতে থাকা পোস্টারে লেখা দেখা গেছে, ‘আমাদের স্বপ্ন মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের উচ্চতার থেকেও বড়।’ এমনকি এনএলডির ট্রেডমার্ক অনুযায়ী, দোকানে দোকানে লাল বেলুন বিক্রিও বেড়ে গেছে।
বিক্ষোভ বেড়ে গেলেও বেশ কিছু আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। ইয়াঙ্গুনে একটি চায়ের দোকান চালান হেই উইন। তিনি ১৯৮৮ এবং ২০০৭ সালে বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন। ওই দুই সময়ই তিনি বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশকে গুলি চালাতে দেখেছেন। এতে শত শত মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। তিনি বলেন, আমি শতভাগ নিশ্চিত যে সেনাবাহিনী কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে যাচ্ছে।
জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের আশ্বাস হয়তো কোনো কাজেই আসবে না। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সতর্ক করছে, মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিকদের হয়তো গা ঢাকা দিতে হতে পারে। মানবাধিকার সংগঠন অ্যাসিসটেন্স অ্যাসোসিয়েশন অপর পলিটিক্যাল প্রিজোনার্সের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত দেশটিতে বিক্ষোভ অংশ নেয়ায় প্রায় ২শ মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
ইয়াঙ্গুনসহ ১৯টি জেলা, বড় শহর এবং রাজধানী নেপিদোর বেশিরভাগ এলাকায় কারফিউ জারি করা হয়েছে। এছাড়া পাঁচজনের বেশি মানুষের একত্রিত হওয়ার ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে।
এছাড়া বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভকারীদের ওপর টিয়ার গ্যাস, জল কামান এবং রাবার বুলেট ছুড়েছে পুলিশ। এদিকে রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম বলছে, মানদালায় প্রায় ২ হাজার বিক্ষোভকারী পুলিশের ওপর ইট এবং বোতল ছুড়েছে।
সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা গেছে, পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর লাঠি নিয়ে হামলা চালিয়েছে। তিন বিক্ষোভকারী রাবার বুলেটের আঘাতে জখম হয়েছেন। নেপিদোতে দুই বিক্ষোভকারীর ওপর গোলাবারুদ নিক্ষেপ করা হয়েছে। এছাড়া মিয়া থোয়ি খিনে নামে এক নারী গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন।
এখনও পর্যন্ত বিক্ষোভ থামার কোনো লক্ষণ নেই। তরুণ, শ্রমিক, সরকারিসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষের অংশগ্রহণ বাড়ছেই। দেশজুড়ে শিক্ষক, দমকলকর্মী এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা ধর্মঘট শুরু করেছেন। তারা কাজ বন্ধ রেখেছেন। সরকারি কর্মচারীদের পদত্যাগের হিড়িক পড়েছে। ইতোমধ্যেই দেশটির সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সব কর্মী ইস্তফা দিয়েছেন।
গত ১০ ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনীর নির্দেশনা অমান্য করে পুলিশ কর্মকর্তাদের একটি গ্রুপ বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে একাত্মতা জানিয়ে বিক্ষোভে অংশ নেয়। এর পরদিনই কায়াহ রাজ্যের কয়েক ডজন পুলিশ সদস্য সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান ব্যক্ত করেন।
সিঙ্গাপুরের থিংক-ট্যাংক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের অ্যারন কনলি বলেন, জেনারেল মিন অং হ্লাইং মনে করছেন, ‘বিক্ষোভ হয়তো আপনা আপনিই থেমে যাবে এবং তারা এই মুহূর্তে যা চাইছেন তাই হবে।’
কিম জলিফ নামের এক বিশেষজ্ঞ বলছেন, ‘আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং কিছু বিদেশি ব্যবসায়ী দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণে সবকিছু আগের স্থিতিশীল পরিস্থিতিতে ফিরে যাওয়াটা বেশ কঠিন বিষয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘২০০৭ সালের বিক্ষোভের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে বর্তমানের তরুণ জনগোষ্ঠী আরও বেশি শিক্ষিত, সুসংগঠিত এবং একে অপরের সঙ্গে অনেক বেশি সম্পৃক্ত। তারা খুব সহজেই থেমে যাবে এমন সম্ভাবনা খুবই কম।’
হঠাৎ করেই দেশজুড়ে সামরিক অভ্যুত্থানের ঘটনায় সাধারণভাবেই মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর বিষয়ে মানুষের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এসথার জে নাও নামে ২৭ বছর বয়সী এক মানবাধিকার কর্মী বলছেন, শুধু বেসামরিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করলেই চলবে না বরং জেনারেলদের তৈরি সংবিধান সংশোধনের বিষয়টিও পুনর্বিবেচনা করতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা যদি সামরিক সরকারকে বিলুপ্ত করতে না পারি তবে পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্র কখনও তৈরি করা সম্ভব হবে না।
২২ বছর বয়সী আরও এক নামকরা মানবাধিকার কর্মী ‘বিপ্লবের’ কথা বলেছেন। তিনি বলছেন, যদি অসহিংস এই বিক্ষোভ সফল না হয় তবে তিনি অস্ত্র হাতে নেবেন। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় মিন অং হ্লাইং এই সামরিক অভ্যত্থান সফল হবে বলে আশা করেছিলেন। কিন্তু সেটা মোটেও হচ্ছে না।’

সূত্র : দ্য ইকোনমিস্ট

 

Please Share This Post in Your Social Media

এই বিভাগের আরো সংবাদ
© ২০২০ দৈনিক জাতীয় অর্থনীতি