এডিস মশার লার্ভার বংশবিস্তারে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে তৈরি হয়েছে উদ্বেগ। ২০১৯ সালে তান্ডব চালিয়েছিল ডেঙ্গু। এ বছর সে তুলনায় লার্ভার ঘনত্ব ও প্রজননস্থল বেশি। উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ৫৫টি ওয়ার্ড। শুধুু ঢাকা নয়, চট্টগ্রাম, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বাড়ছে ডেঙ্গুজ্বরের রোগী। তাই এখনই ব্যবস্থা না নিলে আগস্টে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়ংকর হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘প্রাকবর্ষা জরিপে লার্ভা বেশি পাওয়ার অর্থ সামনে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। এখন ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগী বাড়তে থাকবে। এ পরিস্থিতি আগস্ট পর্যন্ত চলবে। শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশেই আক্রান্ত বাড়বে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম, গাজীপুর, পটুয়াখালী, বরিশালে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি থাকবে।’ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘এখন হটস্পট ম্যানেজমেন্টে জোর দিতে হবে। হাসপাতাল থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর ঠিকানা নিয়ে হটস্পট শনাক্ত করতে হবে। এরপর ওই জায়গায় ক্র্যাশ প্রোগ্রাম নিয়ে উড়ন্ত মশা নিধন করতে হবে। যেসব জায়গায় রোগী নেই, সেখানে লার্ভা শনাক্ত ও ধ্বংস করতে হবে। এ কাজে জনগণকে সম্পৃক্ত করে সচেতনতা বাড়াতে হবে।’
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ২৭ ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ২৮ ওয়ার্ড রয়েছে উচ্চঝুঁকির তালিকায়। স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, প্রাকবর্ষা জরিপ অনুযায়ী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের সব এলাকায়ই ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার উপস্থিতি বেশি। এবার ডেঙ্গুর মৌসুম গত বছরের মতো দীর্ঘ হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। সিটি করপোরেশনের জোরালো কার্যক্রমের পাশাপাশি নগরবাসী সচেতন না হলে পরিস্থিতি ভয়ানক রূপ নিতে পারে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম বলেন, ঢাকার দুই সিটির ৯৮ ওয়ার্ডের মধ্যে ৫৫টিতেই ব্রুটো ইনডেক্স ২০-এর বেশি। এর অর্থ হচ্ছে, এসব এলাকার ১০০টির মধ্যে ২০টির বেশি পাত্রে মশা বা লার্ভা পাওয়া গেছে। গত বছর ৯৮টি ওয়ার্ডের মধ্যে মাত্র তিনটিতে ব্রুটো ইনডেক্স ২০-এর বেশি ছিল।
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালে প্রথম ছয় মাসে মারা গিয়েছিলেন আটজন। আক্রান্ত হয়েছিলেন ২ হাজার ২০৮ জন। এ বছর ছয় মাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৮ হাজার ২৪৮ জন, মারা গেছেন ৫০ জন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমারজেন্সি ও অপারেশন সেন্টার সূত্রে জানা যায়, গতকাল ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫৮৪ জন, মারা গেছেন একজন। এ পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১০ হাজার ৪৫৫ জন, মারা গেছেন ৬২ জন। গত পাঁচ দিনে মারা গেছেন ১৫ জন। বাংলাদেশে গত শতাব্দীর ষাটের দশকে প্রথম ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। এরপর পাঁচ বছর আগে ২০১৯ সালেই পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল। ওই বছর ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে মৃত্যু ঘটে ১৭৯ জনের। আক্রান্ত এবং মৃতদের বেশির ভাগই ছিলেন রাজধানী ঢাকার বাসিন্দা। ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, দেশে আশঙ্কাজনকহারে ডেঙ্গু সংক্রমণ বাড়ছে। মশা নিধনে দায়িত্বরতদের আরও কার্যকর ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। গতকাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের আন্তবিভাগ ও অপারেশন কার্যক্রম উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি এসব কথা বলেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘ডেঙ্গু সংক্রমণ আবারও বাড়ছে। আমাদের হাসপাতালগুলো চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছে। রোগীদের ব্যবস্থাপনাটা আমরা দেখছি। মশাটা যাতে নিধন হয় সেই ব্যবস্থাটা করতে হবে। হাসপাতালগুলো রোগীতে ভরে যাচ্ছে। চিকিৎসকরা দিনরাত সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। রোগীর যেন মৃত্যু কম হয় চিকিৎসকরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে রোগীদেরও দায়িত্ব রয়েছে। যথাসময়ে হাসপাতালে আসতে হবে।’ মশক নিধনে তিন দিনের বিশেষ চিরুনি অভিযান শুরু করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। বাসাবাড়িতে অভিযান চালিয়ে ধ্বংস করা হচ্ছে এডিসের লার্ভা। লার্ভা মিললে মামলা ও জরিমানার আওতায় আনা হচ্ছে বাড়ির মালিককে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছেন, ‘ডেঙ্গু নির্মূল কেউ করতে পারবে না। পৃথিবীর কোনো দেশ করতে পারেনি। তবে আমরা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছি। আপনারা যদি উন্নত দেশের সঙ্গে তথ্য ও পরিসংখ্যান মিলিয়ে দেখেন, তাহলে দেখবেন অন্যান্য দেশের তুলনায় এখন পর্যন্ত আমরা ভালো অবস্থানে রয়েছি। যদিও আমাদের মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পাচ্ছে।’ গতকাল সোনারগাঁও হোটেলসংলগ্ন হাতিরঝিল পানি নিষ্কাশন যন্ত্র পরিদর্শন শেষে গণমাধ্যমের সঙ্গে মতবিনিময়কালে মেয়র এ কথা বলেন। এডিস মশার প্রজননস্থল কিংবা লার্ভা পাওয়া যেতে পারে এমন স্থান ও স্থাপনার তথ্য দিয়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ঢাকাবাসীর দায়িত্বশীল সহযোগিতা চেয়েছেন ডিএসসিসি মেয়র। তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করলে ১৫ মিনিটেই করপোরেশনের মশককর্মী সংশ্লিষ্ট স্থানে পৌঁছে মশার লার্ভা ধ্বংসের উদ্যোগ গ্রহণ করবেন বলেও জানান তিনি। এ সময় ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমানসহ করপোরেশনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। মশক নিধনে মাসব্যাপী বিশেষ কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। ৮ জুলাই থেকে ডিএনসিসির প্রতিটি ওয়ার্ডে একযোগে চিরুনি অভিযান পরিচালনা করা হবে। গতকাল রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ড্রোনের মাধ্যমে ভবনের ছাদবাগানে মশার উৎস চিহ্নিতকরণ কার্যক্রমের উদ্বোধন করে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা এ ঘোষণা দেন। মো. সেলিম রেজা বলেন, ‘বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে। সচেতনতা বাড়াতে আমরা ব্যাপক প্রচার চালাচ্ছি। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রাখতে ৮ জুলাই থেকে মাসব্যাপী বিশেষ মশক নিধন কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। এডিসের লার্ভা পেলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন ডিএনসিসির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা।’