রাতের গভীরতা নীরবতা নিয়ে আসে জাদুর শহরে। কর্মব্যস্ত শহরের ছাপ থাকে না সে নীরবতায়। প্রতিনিয়ত চমক নিয়ে হাজির হয় রাতের ঢাকা। একদম বদলে যাওয়া নগরীতে রাতের চিত্র যেন একটু বেশি আকর্ষণ করে আমাকে। আমি রাতের মায়াবী আবহে মুগ্ধ হয়ে নীরবে উপভোগ করি সে দৃশ্য। রাত ১২টায় ইদানিং পান্থপথ সিগনালের কাছে হাতে ফেরি করা চায়ের স্বাদ নেওয়ার নেশা পেয়েছে। দু’চার জন সঙ্গীও জুটেছে সে আড্ডায়। মাঝেমধ্যে একা হয়ে যায় তবে বয়সে আমার অনেক বড় হলেও সাংবাদিক রবু ভাই আমার অনেকটা নিয়মিত সঙ্গী। চায়ের চুমুকে রাজনীতি-অর্থনীতি, সভ্যতা-সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের আলোচনা জমে ওঠে। সে আলোচনা সমাজ বা রাষ্ট্রের কোন কাজে না এলেও আমাদের মনে প্রশান্তি আনে বৈকি।
শীতের রাতে কুয়াশায় সোডিয়াম বাতির আলো কিছুটা অস্পষ্ট লাগছে। শীতের প্রকোপও রাজধানীতে বাড়তে শুরু করেছে। শীতল হাওয়া বয়ে গেলে শরীরে শীতল আবহের পরশ নিছক শীত নয়, সাথে রোমান্টিকও বলা যায়। আমি রবু ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করছি। পান্থপথ সিগনালে শৈত্যপ্রবাহের মাঝেও গোটা দশেক লোক রয়েছে। আমার মতো আরও কয়েকজন আড্ডাপ্রিয় মানুষ দেখে ভালো লাগছে। রবু ভাই যোগ দেওয়ায় সেটির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে একটি একাদশ টিমে রূপ নিলো। নীরব পরিবেশে মাঝে মধ্যে দ্রুত গতিতে ছুটে চলা গাড়ি কিছুটা ছেদ টানছে নীরবতায়। রাস্তায় দু’একটি রিকশা চোখে পড়ছে। সিয়ামের কাছ থেকে জাকারিয়া ভাই সিগারেট ধরিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। সিয়াম নিয়মিত এখানে বসে সিগারেট বিক্রি করে। তার বয়স হবে ৭-৮ বছর। সে দেখতে এত সুন্দর যে, তার সৌন্দর্য মুগ্ধ করবে যে কাউকে। আমরা তাকে অনেক স্নেহ করি। পরিবারের প্রয়োজনে বিকাল থেকে সে কাজটি করে। পরিবারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে এ বয়সে নেওয়া অনেক বড় নির্মম বাস্তবতা। সিয়ামকে দেখে আমার ভীষণ মায়া হয়। আরও মায়া লাগে এই শীতের রাতে পথশিশুসহ রাস্তায় ঘুমিয়ে থাকা মানুষগুলোর জীবনযাপন দেখে। বেঁচে থাকার তাগিদে এ জীবন সংগ্রামে লড়াই করা মানুষগুলো নিশ্চয়ই শ্রদ্ধা পাওয়ার যোগ্য। কুয়াশায় নিয়ন বাতি আলো-ছায়ায় খেলা করছে।
জাকারিয়া ভাই সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে তার প্রেয়সীর সাথে অনেকদিন পর সাক্ষাতের খবরটি শোনালেন। তার চোখের টলটল ভাব নিশ্চয়ই প্রেয়সীর অনুপস্থিতির উপলব্ধি, তার মুখের মলীনতা আবেগতাড়িত ভাব প্রকাশ করে। কিছুটা ভাঙা ভাঙা কণ্ঠস্বরে বললেন শেষ বিদায়ের কথা। কথা শেষে যতটুকু বুঝতে পারলাম মালিহা আপুর রাত পোহালে গায়ে হলুদ। তিনি নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছেন। ছেলে পেশায় ব্যাংকার, পরিবারের পছন্দে এ সিদ্ধান্ত তাকে মেনে নিতে হচ্ছে। ফলে জাকারিয়া ভাইয়ের সাথে দীর্ঘ চার বছরের সম্পর্কের ইতি ঘটতে যাচ্ছে। খবরটি নিশ্চয়ই আমাকে আশাহত করলো। মালিহা আপুর সাথে আমারও স্মৃতি কম নয়। ভাইয়ের সাথে গিয়ে অনেকবার আমি সাক্ষাৎ করেছি। সুতরাং সে স্মৃতি নিশ্চয়ই ভেসে উঠছে চোখের পাতায়। ভাইয়ের দুঃখ ঘোচাতে কিছুটা সান্ত্বনা দেওয়ার বৃথা চেষ্টা ছাড়া আর কী করার আছে আমার!
গাড়ি ছুটে চলেছে তার আপন গতিতে। আজ বেশ কুয়াশা পড়ছে। আমরা আড্ডা শেষে নিজেদের গন্তব্যে রওনা হলাম। বাসায় এসে জাকারিয়া ভাইয়ের মলীন মুখ চোখে ভাসতেই আমাকে ভীষণ পীড়া দিচ্ছে। ভাইয়ের সাথে আমার সম্পর্কটা বলা যায় পারিবারিক। ভাইয়ের বাবাও আমাকে অনেক স্নেহ করেন। সব সময় নিজেকে সামলে নেওয়া মানুষটি আজ প্রিয়জনকে হারানোর ব্যথা সইতে পারছে না। আসলেই মন দেওয়া নেওয়ার খেলা সবকিছু থেকে আলাদা। নেশার চেয়ে বড় নেশা আবেগের সম্পর্কের খেলা।
আজ আমার ঘুম আসছে না, সবার কিছুটা ছুটি প্রয়োজন হয়। আজ ঘুমের ছুটির দিন। ঘুম না এলে বেলকনিতে চেয়ারে বসে আমি বই পড়ি। বাইরে শীতল বাতাস বইছে। আজ খাটে শুয়ে শুয়ে কিছুটা পড়ার চেষ্টা করছি। ঘড়িতে রাত দুটা বেজে পনেরো মিনিট। জাহানারা ইমামের লেখা একাত্তরের দিনগুলি বইয়ে চোখ বোলাই। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রতিটি দিন কতটা উৎকণ্ঠার ছিল ভাবতেই শিউরে উঠি। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ছেলে শহীদ রুমি। আনিসুল হকের লেখা মা উপন্যাসের আজাদ এবং রুমির কথা ভাবতেই নিজের মধ্যে দেশপ্রেম অনেক বেড়ে যায়। ইচ্ছা হয়, তাদের মতো নিজেকে শপে দিয়ে কিছু একটা করি দেশের জন্য।
মোবাইলের ভাইব্রেশনে খাটের কম্পন রাতের নিস্তব্ধতায় অনেকটা ভূমিকম্পের আবহ নিয়ে আসে। এত রাতে সাধারণত আমার ফোন আসে না। মোবাইলটি হাতে নিতেই চোখে পড়লো বন্ধু মমিনের নাম। এত রাতে তার ফোন পাওয়া কিছুটা অপ্রত্যাশিত বলা যায়। রিসিভ করতেই সে উৎকণ্ঠা নিয়ে বললো,
‘বন্ধু রাজা কিডন্যাপ হয়েছে।’
আমি তো আশ্চর্য শুনে।
‘কিভাবে, কখন ঘটলো এমন ঘটনা?’
‘লক্ষ্মীবাজার থেকে বাসায় ফিরছিল। এর মধ্যে সে গায়েব। একটি নম্বর থেকে ফোন দিয়ে আমার কাছে পাঁচ লক্ষ টাকা দাবি করেছে। টাকা দিলে ছেড়ে দেবে।’
শীতের রাত, কুয়াশাও ভালোই পড়ছে। নিয়ন বাতির আলো কুয়াশায় ঢেকে অন্ধকার নেমে এসেছে। পান্থপথেের মোড়ে একটি রিকশা পেলাম। এত রাতে বয়স্ক চাচা যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছে ভাবতেই কেমন একটা অনুভূতি হলো নিজের কাছে। জনমানবশূন্য ব্যস্ত নগরীতে এত রাতে নিজেও নিরাপত্তাহীনতা বোধ করলাম। তারপরও রিকশায় চড়তে হবে।
‘চাচা, ওয়ারী থানার সামনে যাবেন?’
‘চলেন, একশ পঞ্চাশ টাকা দিতে হইবো।’
‘একশ টাকা দিবো চাচা।’
‘শীতের রাইতে আমি কষ্ট কইরা বইসা আছি কিছু পয়সার জন্য। একশ টাকা দিলে হইবো না।’
উপায় না দেখে অবশেষে রাজি হলাম। রিক্শায় চড়তেই মমিনের ফোন। সেও কাছাকাছি চলে এসেছে। আমিও আশ্বস্ত করলাম দ্রুত সময়ের মধ্যে চলে আসবো।
চাচার বয়স ষাটের বেশি হবে। এ বয়সে কষ্ট করে রাত জেগে রিকশা চালানো আমাকে অবাক করলো। কথা প্রসঙ্গে জানতে পারলাম, তার দু’ ছেলে উচ্চশিক্ষিত। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করেন। তবে তারা বাবা-মার খোঁজ রাখেন না। চাচারও তাতে কোন আক্ষেপ নেই। তাদের সুখে থাকা তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আসলে বাবা-মা এমনই হয়। চাচার জন্য কিছুটা খারাপ লাগলো। যদিও আমাদের জীবনের নিয়তি মেনে নিতে হবে। ইতোমধ্যে মমিন আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি ভাড়া দিয়ে রিকশা থেকে নেমে মমিনের সাথে বিস্তারিত আলোচনা সেরে নিলাম।
রাজাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে টাকার জন্য, বিষয়টি এমন না-ও হতে পারে। এর মধ্যে অন্য কোন কারণও থাকতে পারে। আমাদের সব কিছু ভেবে কাজ করতে হবে। রাজা কিডন্যাপারকে মমিনের নম্বর দেওয়ার কারণ তার বাড়িতে জানলে পরিস্থিতি খারাপ হবে। আঙ্কেল-আন্টির মানসিক অবস্থার কথা ভেবে সে মমিনের কাছে ফোন দিয়ে টাকার বিষয়টি বলিয়েছে।
থানায় বিষয়টি অবহিত করার পূর্বে আমি পরামর্শ নিতে আমাদের ডিপার্টমেন্টের বড়ভাই সহকারী পুলিশ সুপার রাসেল ভাইকে ফোন দিলাম। অনেক রাত হলেও ভাই ফোন রিসিভ করলেন। ঘটনা খুলে বললাম। ভাই ওয়ারী সার্কেলে দায়িত্বে থাকা তার ব্যাচমেটকে রেফার করে ডিটেইলস বুঝিয়ে দিলেন। আমরা থানায় গিয়ে তাকে ফোন দিলে তিনি বিষয়টি দেখবেন বলে আশ্বস্ত করলেন। ইতোমধ্যে নম্বরটি থেকে আবারো ফোন এলো। মমিন আমাকে ধরিয়ে দিলো। কিছুটা কম বয়সী কণ্ঠ। টাকা দেওয়ার আপডেট জানতে চাইলো। আমি আশ্বস্ত করলাম, রাতেই তাদের দেওয়া লোকেশনে টাকা পৌঁছে দেওয়া হবে। না দেওয়ার পরিণতি সম্পর্কেও সে আমাকে অবহিত করলো। প্রশাসনকে জানালে ভয়াবহ হবে পরিস্থিতি, সে হুমকিও পেলাম।
ইতোমধ্যে দু’ ঘণ্টা অতিক্রম হয়েছে। থানায় হন্তদন্ত হয়ে রাসেল ভাইয়ের ব্যাচমেট শুভ মালিথা পৌঁছালেন। আমরা আমাদের কাছে থাকা তথ্য তাকে জানালাম। তবে এর পেছনে কোন কারণ আছে কি-না আমাদের ধারণা নেই।
রাজা লক্ষ্মীবাজার থেকে নারিন্দা ফেরার পথে দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে কিডন্যাপ হয়েছে। মমিনের কাছে ফোন আসে রাত দু’টার দিকে। বাকিটা সময় কিডন্যাপাররা নিজেদের প্রস্তুতি নিয়েছে। ঘটনাটি ওয়ারী-সূত্রাপুরের দিকে হওয়ায় মূলত আমি ওয়ারী থানায় ইনফর্ম করার পরিকল্পনা করলাম। এখানে মমিনেরও বাংলাবাজার থেকে আসতে বেশি সময় লাগবে না। আমাদের যদিও এখন বেশি সময়ক্ষেপণ করা ঠিক হবে না। শুভ ভাই বনানীর দেওয়া ঠিকানায় টাকা নিয়ে এসে ফোন দেওয়ার কথা তাদের জানাতে বললেন। তাদের স্পেশাল টিম এবং বনানী পুলিশের সাথে ইতোমধ্যে যোগাযোগ করে নম্বর ট্রাক করলেন।
ইতোমধ্যে রাত চারটার বেশি বাজে। তাদের সাথে যোগাযোগ হলো। তবে আমাদের শর্ত, টাকা দিয়ে সাথে সাথে বন্ধুকেও ফেরত চাই। তারা শর্ত মেনে নিলো। আমরা কাকলী থেকে একটু ভেতরের গলিতে গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে গেলাম তাদের দেওয়া গন্তব্যের দিকে। পুলিশের স্পেশাল টিম আমাদের ফলো করছে। সাথে ট্রাকিং করে লোকেশনের দিকে যাচ্ছে আরেকটি ইউনিট।
ফর্সা করে অল্প বয়সী একটি ছেলের দেখা পেলাম। বর্ণনা অনুযায়ী মিল আছে। সে আমাদের কাছে এলো। টাকা কোথায় জানতে চাইলো। বললাম, পকেটে আছে কিছু আর কিছু প্যাকেটে। রাজাকে সামনে আনলে টাকা হস্তান্তরের শর্ত পূরণের কথা বলতেই সে সহ কয়েকজন ইতোমধ্যে আমাদের উপর চড়াও হলো টাকা ছিনিয়ে নিতে। ততক্ষণে পুলিশ এসে হাজির। তারা পুলিশের জালে আটকে গেলো। কারণ আমাদের অনুসরণ করা পুলিশ ইউনিট সম্পর্কে তারা অবগত নয়। রাজার সিচুয়েশন নিয়ে আমরা চিন্তিত হয়ে পড়লাম। ইতোমধ্যে পুলিশ নম্বর ট্রাক ও লোকেশন অ্যানালাইসিস করে ভবনে রেড দিয়েছে।
রাজার সাথে বছরখানেক হলো প্রেমার পরিচয়। ফেসবুকে তাদের প্রথম পরিচয়। রাজার সাথে সাক্ষাৎ করতে মাঝেমধ্যে মেয়েটি ক্যাম্পাসে এসেছে। ফলে দু’চার দিন কথা হয়েছে। ভবনটি থেকে পুলিশ প্রেমাকে আটক করায় আমরা চমকে গেলাম। প্রেমা তুমি! বলতেই কোন উওর এলো না। অনেকটা নীরবতা নেমে এলো। শুভ ভাই বললেন, মেয়েটি চক্রের প্রধান। সম্পর্কের বাহানায় কিডন্যাপিংয়ের জগতে সদ্য পা দিয়েছে তারা। ফলে অভিযানে আমাদের বেশি বেগ পেতে হয়নি। এমন চক্র ইদানিং জাল বিস্তার করেছে শহরে।
জাদুর শহরে কুয়াশা ভেদ করে সূর্যের আলো উঁকি দিচ্ছে। শ্বাসরুদ্বকর সময় কাটলো আমাদের। রাজাকে দেখতে পেয়ে আতঙ্কমুক্ত হলাম। বন্ধুর সাথে আনন্দে কুশল বিনিময় করতেই পকেটে ফোন নড়ে উঠলো। ফোন হাতে নিয়ে চোখ বোলাতেই জাকারিয়া ভাইয়ের বাবার নাম ভেসে উঠলো। এমন সময় মনে পড়লো, আজ তো মালিহা আপুর গায়ে হলুদ! ভাইব্রেশনে ফোনের কম্পনের সাথে মনের কম্পনও বাড়তে লাগলো।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।