রবিবার সকাল বেলা। ইকবাল তড়িঘড়ি করে ঘুম থেকে উঠেছে। আজ তার কাজে যেতে হবে। সিডনির ডার্লিং হারবারের একটা স্প্যানিশ রেস্টুরেন্টে সে সপ্তাহে শনি-রবিবার কাজ করে। অন্যদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস থাকে।
ক্যাম্বেলটাউন থেকে সে ট্রেনে উঠেই প্রতিদিনের অভ্যাসমতো কানে হেডফোন লাগিয়ে ঝিমধরে বসে আছে। তন্দ্রার মধ্যে সে আশেপাশে কিছু পড়ার শব্দ পেয়ে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে একটি অতি পুরানো মডেলের নকিয়া মোবাইল তার সিটের পাশের রাস্তায় পড়ে আছে।
ইকবাল মোবাইলটি হাতে তুলে নিতেই মোবাইলের পেছনে একটি সাদা স্টিকারে বাংলায় মালিকের নাম সুফিয়া বেগম ও ফোন নাম্বার দেখতে পায়। উইকএন্ডে সকালের ট্রেনগুলিতে তেমন একটা ভিড় থাকে না। সে সামনের সিটে বসা বোরখা পরিহিত ফোনের মালিককে চিনতে পেরে তার সামনে গিয়ে বাংলায় বলে, ‘এক্সকিউজ মি, আপনার ফোনটা ট্রেনে ওঠার সময় পড়ে গিয়েছিল।’
কোন জবাব না পেয়ে ইকবাল আবারও বলে, ‘আপনার ফোনটা নিন প্লিজ।’ এবারও কোন উত্তর পায়না। কিন্তু বোরখার ভেতর থেকে সে চাপা কান্নার আওয়াজ শুনতে পায়।
ইকবাল কিছুটা কিংকর্তব্য বিমুড় হয়ে তার পাশের সিটে বসে পড়ে। বোরখার ভেতর থেকে বের করা হাত দেখে তাকে বৃদ্ধা বলে মনে হয়। সে বৃদ্ধাকে কিছুটা ধাতস্থ হাওয়ার সময় দিয়ে বলে, ‘চাচী, আপনার ফোনটা নেন, প্লিজ।’ এ কথা শোনার পর বৃদ্ধার কান্না আরও বেড়ে যায়।
বেশ কিছুক্ষণ পড়ে বৃদ্ধা নিচু কণ্ঠে বলেন, ‘বাবা, আমার ফোনটা দরকার নেই। আপনি ওটা ফেলে দেন।’
ইকবাল কিছুটা ঘাবড়ে যায়। সাহস করে বলে, ‘চাচী, কি হয়েছে আমাকে বুঝিয়ে বলবেন।’ কিছুক্ষণ পরে বৃদ্ধা বলতে থাকেন, ‘বাবা, আমার ফোনটার দরকার নেই। আপনি দয়া করে ফোনটা ফেলে দেন। ফোনটা আমার কাছে থাকলে ওরা আমাকে খুঁজে বের করে ফেলবে।’
ওরা, কারা চাচী?
বৃদ্ধা তার মুখের উপরের বোরখার পর্দা সরিয়ে উত্তর দেয়, ‘আমার ছেলে ও বৌ।’
ইকবাল এতক্ষণে বিষয়টা ধরতে পারে। সে নরম সুরে বলে, ‘চাচী ঠিক আছে। আমি ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনের ডাস্টবিনে ফোনটা ফেলে দেব।’ এই বলে সে মোবাইল ফোনের সুইচটা অফ করে রাখে।
তারপর বৃদ্ধাকে ভয় পাইয়ে দেবার জন্য বলে, ‘চাচী, আপনি কোন স্টেশন পর্যন্ত টিকেট কিনেছেন?’
বৃদ্ধা ভীতু ভঙ্গিতে বলেন, ‘বাবা, টিকেট কিভাবে কাটতে হয় আমি জানিনা। রাগ করে বাসা থেকে বেরিয়ে এসে সোজা ট্রেনে চেপে বসেছি। হাতব্যাগেও কোনো টাকা পয়সা নেই। এখন কি হবে?’
তাহলে চলেন সামনের স্টেশনে নেমে ফিরতি ট্রেনে আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি। এতক্ষণ হয়তো আপানার ছেলে চিন্তা করছেন।
বৃদ্ধা রাগী কণ্ঠে বলে, ‘আমি কোনদিন আর ওই বাসায় ফিরে যাবো না। ইকবাল বুঝতে পারে বৃদ্ধাকে এভাবে বাড়িতে ফিরিয়ে নেওয়া যাবে না।’
চাচী, আপনি একটু বসেন। আমি পেছনের ছিট থেকে আমার ব্যাগটা নিয়ে আসি। পেছনের সিটে ফিরে গিয়ে সে তার রেস্টুরেন্টের ম্যানেজারকে ফোন করে কাজে যেতে পারবে না বলে জানিয়ে দিয়ে বৃদ্ধার কাছে ফিরে আসে।
ওরা দুইজন সার্কুলার কি’তে নেমে ওপাল কার্ড দিয়ে স্টেশন থেকে বেরিয়ে আসে।
আজ মাদার্স ডে। বেলা দশটার মতো বাজে। সিডনির সার্কুলার কি’তে এখনও লাঞ্চের ভিড় শুরু হয়নি। তবে লাঞ্চের সময় এখানের রেস্টুরেন্ট গুলোতে দাঁড়ানোর জায়গাও পাওয়া যাবে না। ইকবাল বৃদ্ধাকে এক জায়গায় বসিয়ে রেখে পানি কেনার উছিলায় একটি সি ফুডের দোকানে লাঞ্চের টেবিল বুক করে রাখে।
তারপর বৃদ্ধার হাতে পানির বোতল ও মাফিন ধরিয়ে দিয়ে অপেরা হাউজের দিকে হাটতে থাকে। অপেরা হাউজের সিঁড়িতে ওঠানামা করে বৃদ্ধা ক্লান্ত হয়ে গেলে অবশেষে তারা এক জায়গায় বসে পড়ে।
টয়লেটে যাবার উছিলায় সে একটু দূরে গিয়ে বৃদ্ধার মোবাইল ফোন অন করে তার ছেলের সেফ করে রাখা নম্বরে ফোন করে তাদের আশ্বস্ত করে।
বৃদ্ধার কাছে ফিরে গেলে সে কথায় কথায় ইকবালকে জানায়, ‘সে ছয় মাস আগে দেশ থেকে এসেছে। এখানে তার ছেলে বৌ আর নাতনি তাকে প্রায় মাথায় করে রেখেছে। কিন্তু দেশে বসত বাড়ির সামনেই তার স্বামীর কবর। তাকে ছেড়ে কোথাও গিয়ে থাকতে তার ভালো লাগে না। গত তিনমাস ধরে ছেলে বৌকে অনুরোধ করছে তাকে দেশে নিয়ে যেতে। কিন্তু তারা কেউ যেতে দিতে চায়না। তাই সে রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্রেনে উঠেছে।’
দুপুর সাড়ে বারটার মতো বাজে। ইকবাল ও সুফিয়া বেগম সার্কুলার কি’র একটি সি ফুড রেস্টুরেন্টে বসে আছেন। তাদের সামনে প্লেট ভর্তি খাবার। রেস্টুরেন্টে তিল ধারণের জায়গা নেই। সুফিয়া খাতুন বিস্ময় দৃষ্টিতে রেস্টুরেন্টের চারিদিকে তাকিয়ে আছে। সবাই তাদের মা’দের নিয়ে খেতে এসেছে। ইকবাল টয়লেটে গিয়ে কান্না জড়িত কণ্ঠে দেশে তার মা’কে ফোন করে।
হ্যাপি মাদার্স ডে। তার মা কিছুই বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করেন, ‘মোর ইকবালের দেশ থনে কে কইতে আছেন বাবা?’