জানা গেছে, দেশে বিটুমিনের মোট চাহিদার মাত্র ২০ শতাংশ পূরণ করে সরকারি প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড। বাকি ৮০ শতাংশ চাহিদা মেটানো হয় আমদানি করা বিটুমিন দিয়ে। অথচ বিটুমিন আমদানির পুরো প্রক্রিয়াই প্রশ্নবিদ্ধ।
জানা গেছে, বিএসটিআইয়ের মান যাচাই ছাড়াই আমদানি করা হচ্ছে নিম্নমানের বিটুমিন। পাশাপাশি বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন ও বুয়েটের মান যাচাই ছাড়াই দেশে আসছে আমদানি করা বিটুমিন।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, আমদানি করা বিটুমিন মাসের পর মাস রাখা হচ্ছে অবৈজ্ঞানিক উপায়ে। এর ফলে গুণগত মান নষ্ট হচ্ছে।
ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) সহযোগী অধ্যাপক ও বিটুমিন বিশেষজ্ঞ ড. নাজমুস সাকিব বলেন, ‘উৎপাদন থেকে আমদানি পর্যন্ত অসাধু ব্যবসায়ীরা নানাভাবে বিটুমিনের গুণগত মান নষ্ট করেন। মুনাফার কৌশলে বিক্রি হচ্ছে হাতে হাতে। এই প্রক্রিয়ায় প্রতিবারই মেশানো হচ্ছে ভেজাল। অনেক ক্ষেত্রে আমদানি করা বিটুমিনের উৎসও থাকে অজানা।’
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিএসটিআইয়ের মান যাচাইহীন এবং কর্তৃপক্ষকে ফাঁকি দিয়ে আমদানি করা এসব নিম্নমানের বিটুমিন ব্যবহার করা হচ্ছে সড়কে। এর ফলে দেশের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ সড়ক নির্মাণের ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিম্নমানের আমদানি করা বিটুমিন ব্যবহারে রাষ্ট্রের ত্রিমুখী ক্ষতি হচ্ছে। এক. বৈদেশিক মুদ্রার অপচয়। দুই. টেকসই উন্নয়ন হচ্ছে না। তিন. ভাঙা যাচ্ছে না কিছু অসাধু ঠিকাদার ও অসৎ ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, টেকসই সড়ক উন্নয়ন করতে হলে দেশীয় ভালোমানের বিটুমিন ব্যবহারের পাশাপাশি নির্মাণকাজে তদারকি বাড়াতে হবে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিএসটিআই, বুয়েট কিংবা ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের গুণগত মান যাচাইয়ের সুযোগ কম থাকায় আমদানিকারকরা বিদেশ থেকে কম দামের নিম্নমানের কিংবা ভেজাল ৮০ থেকে ১০০ গ্রেডের বিটুমিন আমদানি করছেন। আর এসব ভেজাল বিটুমিনই বর্তমানে ব্যবহার করা হচ্ছে দেশের বিভিন্ন সড়কে। এতে করে সড়কগুলো টেকসই হচ্ছে না। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী ৮০ থেকে ১০০ গ্রেডের পরিবর্তে ৬০ থেকে ৭০ গ্রেডের গাঢ় বিটুমিন ব্যবহার করতে হবে। আর বিএসটিআইয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক পণ্যের মান ধরলে গ্রেড অনুযায়ী ৫০ থেকে ৭০ গ্রেডের বিটুমিন খুবই উন্নতমানের ।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রকৌশলীরা জানান, দেশে দুই ধরনের বিটুমিন বাজারজাত হয়। একটি ৬০ থেকে ৭০ গ্রেডের, যা অধিকতর গাঢ়। এই শ্রেণির বিটুমিন রাস্তার পিচ ঢালাইয়ের কাজে ব্যবহৃত হলে সড়ক উন্নত ও টেকসই হয়। আর ৮০ থেকে ১০০ গ্রেডের বিটুমিন কিছুটা তরল। এই বিটুমিন পিচ ঢালাইয়ের কাজে ব্যবহৃত হলে সড়ক টেকসই হয় না। প্রকৌশলীরা আরো জানান, ৮০ থেকে ১০০ গ্রেডের বিটুমিন তরল হওয়ার কারণে গ্রীষ্মকালে সড়কগুলো গলে ঢিবির মতো উঁচু-নিচু আকৃতি ধারণ করে। এতে সড়কে সৃষ্টি হয় অসংখ্য ছোট-বড় গর্ত। আবার বর্ষায় বৃষ্টির সময় ৮০ থেকে ১০০ গ্রেডের বিটুমিন দ্রুত নষ্ট হয়ে সড়কে খানাখন্দ সৃষ্টি করে।
খুলনা সড়ক ও জনপথ বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মনিরুজ্জামান মনির বলেন, ‘দেশের সড়কে ৬০ থেকে ৭০ গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার করা উত্তম। এই গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার করলে সড়ক খুবই টেকসই হয়। ৮০ থেকে ১০০ গ্রেডের বিটুমিন পাতলা হওয়ায় পিচ ঢালাইয়ের কাজে ব্যবহার করা হলে গ্রীষ্মকালে রাস্তা গলে যায়। আমাদের আবহাওয়ার জন্য ৬০ থেকে ৭০ গ্রেডের বিটুমিন উপযোগী। এটি ব্যবহার করা হলে সড়ক টেকসই হয়।’
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) সূত্র জানায়, দেশে বছরে প্রায় দুই লাখ মেট্রিক টন বিটুমিনের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে বিপিসির নিয়ন্ত্রণাধীন ইস্টার্ন রিফাইনারি ৭০ হাজার টন উৎপাদন করে। বাকি বিটুমিন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়। বেসরকারিভাবে আমদানি করা এসব বিটুমিনের গুণগত মান যাচাইয়ের খুব বেশি সুযোগ না থাকায় নিম্নমানের বিটুমিন দিয়ে দেশের সড়ক উন্নয়নের কাজ হচ্ছে।
বিএসটিআইয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘দেশের বাজার আমদানি করা বিটুমিনের নামে ভেজাল এবং মানহীন বিটুমিনে ভরে গেছে। এসব ভেজাল বিটুমিন দিয়ে সড়ক উন্নয়নের কাজ হওয়ায় সড়ক টেকসই হচ্ছে না। কম দামের ভেজাল বিটুমিন দিয়ে সড়কের কাজ হওয়ায় দ্রুত সড়ক ভেঙে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়ছে।’