ইউটিউব চ্যানেল Al Jazeera English- এ ১ লা ফেব্রুয়ারি (২০২১) আপলোড করা All the Prime Minister’s Men। Al Jazeera Investigations ভিডিওটি নিয়ে অপপ্রচারের অভিযোগ উঠেছে আল জাজিরার বিরুদ্ধে। তথ্যচিত্রের মধ্যেই বলা হয়েছে, প্রচারিত ড্রামার তথ্যাদি এক সাইকোপ্যাথের প্রলাপ। আমরা জানি, সাইকোপ্যাথি হলো একটি মানসিক অসুস্থতা বা পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার এই রোগের রোগীদের সাইকোপ্যাথ বলা হয়ে থাকে। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, সাইকোপ্যাথের বৈশিষ্ট্য হলো ধ্বংসাত্মক মনোভাব, মিথ্যাবাদী, নিয়মের কোনো পরোয়া না করা, পরজীবীর ন্যায় জীবনধারা, ধূর্ত, অতীত কালিমালিপ্ত, নিষ্ঠুর আচরণ, সবকিছুতে অবিশ্বাসী, অনুশোচনার অভাব, বদমেজাজী, ভালো কাজে নিরুৎসাহী। আল জাজিরার তথ্যচিত্রে এই সকল বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২ ফেব্রুয়ারি (২০২১) জাতীয় সংসদের সমাপনী ভাষণে দেশ-বিদেশ জুড়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের বিষয়ে সতর্ক থাকার কথা বলেছেন। অন্যদিকে একইদিন উক্ত প্রতিবেদনকে ভ্রান্ত ও ভিত্তিহীন এবং অশুভ অভিপ্রায় উল্লেখ করে তীব্র নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ সেনা সদরদপ্তর। সেনা সদরের প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়েছে, একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী সাম্প্রতিক সময়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। আল জাজিরার প্রতিবেদনের মন্তব্যকারীরা হলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একজন দোষী ডেভিড বার্গম্যান, মাদকাসক্তির অভিযোগে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি থেকে বহিষ্কার হওয়া সাবেক ক্যাডেট জুলকারনাইন সায়ের খান (প্রতিবেদনে সামি হিসেবে আলোচিত) এবং অখ্যাত নেত্র নিউজের প্রধান সম্পাদক তাসনিম খলিল। তাদের অতীত কর্মকাণ্ড এটাই প্রমাণ করে যে এসব স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি অশুভ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে একত্র হয়েছে। উল্লেখ্য, সামিউল আলমের প্রকৃত পরিচয় গোপন করেছে আল জাজিরা। এই ব্যক্তি ইউরোপ বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক, তারেকের অনুগত ও খাম্বা মামুনের পার্টনার। নারী সরবরাহকারী সামী তারেক ও মামুনের মনোরঞ্জনকারী হিসেবেই বেশি পরিচিত। তার ইভেন্ট ফার্ম চালু হয়েছিল একই উদ্দেশ্যে। এই সাইকোপ্যাথের জবানে বর্ণিত আল জাজিরার ভিডিওটির ঘটনা এজন্যই গুরুত্ব হারিয়েছে। অন্যদিকে বিতর্কিত নেত্র নিউজ-এর প্রধান সম্পাদক ও তারেকের ঘনিষ্ট তাসনিম খলিলও বাংলাদেশ বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত। আল জাজিরা কর্তৃপক্ষ এসব মন্তব্যকারীর প্রকৃত পরিচয় গোপন করে শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা সম্প্রচার করেছে।
ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি নিয়ে ১৯৭৬ সালে ‘অল দ্য প্রেসিডেন্ট’স মেন্’ নামে হলিউডে একটি চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছিল। তার কাহিনি ছিল আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের ১৯৭৪ সালের পদত্যাগের ঘটনা। ওই মুভির নামের সঙ্গে মিল রেখে রাজনৈতিক মতলব নিয়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়া আল জাজিরা বর্তমান সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়েছে যা হাস্যকর। কারণ ‘আহমেদ ব্রাদার্স’-এর কাহিনি কোনোভাবেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বিজড়িত নয়। সেনাপ্রধানকে জড়িয়ে গত কয়েক মাসজুড়ে বিদেশে অবস্থানরত সেনাবাহিনীর প্রাক্তন দুজন কর্মকর্তা ফেসবুক লাইভে অপপ্রচার চালাচ্ছে। এমনকি ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার’স মেন’-এর বাংলা ডাবিংও প্রচার করেছে। উপরন্তু শেখ হাসিনার পরিবারকে নিয়ে ইউটিউবে অপপ্রচারের অসংখ্য স্টোরি ছাড়া হয়েছে। আবার আল জাজিরা তথ্যচিত্রটির সপক্ষে মতামত গড়ার জন্য দর্শকদের এখনও ভ্রান্ত তথ্য দিয়ে চলেছে। অথচ সেনাপ্রধানের ছেলের বিয়েতে দেশের বাইরে থাকা দুই ভাইয়ের উপস্থিতি এবং হাঙ্গেরিতে থাকা হারিসের মিথ্যা তথ্যে বানানো পাসপোর্ট সম্পর্কে যে ফটোগ্রাফি ডেভিড বার্গম্যানের জবানিতে দেখানো হয়েছে তা যে ভিডিও সম্পাদনের কারসাজি এটা স্পষ্ট। একইভাবে ২০১৯ সালের ১ মার্চ প্রচারিত আল জাজিরার হেড টু হেড এর Is Bangladesh a one-party state? অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভীকে যেভাবে আক্রমণাত্মক প্রশ্ন করে শেখ হাসিনা সরকারকে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়েছে তাতে মনে করাটা স্বাভাবিক যে এই চ্যানেলটি অনেকদিন ধরে দেশ-বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশ বিরোধীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আসলে ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার’স মেন’ তথ্যচিত্রে আল জাজিরা ইনভেস্টিগেশনের নামে বড় ধরনের মিথ্যাচার করেছে এবং এর মূলহোতা ডেভিড বার্গম্যান, আইনজীবী ড. কামাল হোসেনের মেয়ের স্বামী। আর এর অর্থ জোগান দিয়েছে অপরাধী তারেক জিয়া ও জামায়াত ইসলামীর গডফাদাররা। লেখাবাহুল্য, ১৯৯৬ সালে আরব বিশ্বের প্রথম ২৪ ঘণ্টার সংবাদ চ্যানেল হিসেবে আরবি ভাষায় অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে আত্মপ্রকাশ করা আল জাজিরা ২০০৬ সালে ‘আল জাজিরা ইংলিশ’ সম্প্রচারের পর থেকে অন্য চেহারায় আবির্ভূত হয়। তখন ইউরোপ-আমেরিকার একগুচ্ছ সাংবাদিক যুক্ত হয় এর সঙ্গে এবং ক্রমান্বয়ে তাদের দিয়ে আল জাজিরার রাজনৈতিক মতলবের নতুন দিগন্ত উন্মোচনের সূচনা ঘটে।
একদা বাংলাদেশের ইতিহাস বিকৃতিতে অপরাধের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল, বর্তমানে পুনরায় উস্কানিমূলক সংবাদ পরিবেশন করে শান্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে অশান্ত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে আল জাজিরা। সন্ত্রাসবাদী মতাদর্শে বিশ্বাসী কাতারভিত্তিক এই টিভি চ্যানেল এখন বিশ্বের বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পরিচিত। এটি সর্বপ্রথম আলোচনায় আসে ওসামা বিন লাদেনের সাক্ষাৎকার ও আল কায়েদা সম্পর্কিত খবর প্রচারের মাধ্যমে। ২০১৩ সাল থেকে তালেবান, আল কায়েদা, মুসলিম ব্রাদারহুড ও আইএসসহ বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর কার্যক্রম সম্পর্কে বিশ্বের কাছে খবর পৌঁছানোর মাধ্যম হয়ে ওঠে এটি। ইতোমধ্যে কাতার থেকে জঙ্গি সংগঠনকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার তথ্যপ্রমাণও প্রকাশিত হয়েছে বিশ্বমিডিয়ায়। এই টিভি চ্যানেলে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অপতৎপরতার ভিডিও-চিত্র প্রচারিত হয়ে থাকে হরহামেশায়। আন্তর্জাতিক অপরাধী চক্রের সঙ্গে যোগাযোগ থাকায় এমনটি সম্ভব হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। কারণ ঘটনা ঘটতে পারে এ সংবাদ তাদের সংবাদকর্মীরা আগে থেকে পেয়ে যায়। এজন্যই আফগানিস্তানে আল কায়েদা পরিচালিত অপারেশন, আত্মঘাতী হামলা, ২০০৭ সালের ৭ জুলাই-এ লন্ডনে আত্মঘাতী বোমা হামলা প্রভৃতি ঘটনা একমাত্র আল জাজিরায় প্রচারিত হয়েছিল। এই চ্যানেলটি উগ্রবাদী মতাদর্শে পরিচালিত ও সেই রাজনৈতিক মতাদর্শের মুখপত্র। যুক্তরাষ্ট্র আল-জাজিরার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে এভাবে, এই মিডিয়া নারীর ক্ষমতায়নের বিরোধী, জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক, ধর্মীয় উস্কানি ও হলুদ সাংবাদিকতার পরিপোষক।
২০০৯ সালের পর শেখ হাসিনা সরকারের আমলে বাংলাদেশের নানা ঘটনা নিয়ে অপপ্রচার করে চলেছে আল জাজিরা। তাদের সংবাদ পরিবেশনায় বর্তমান সরকার সম্পর্কে নেতিবাচক খবর সবসময় স্থান জুড়ে বসেছে। তবে বিশ্বব্যাপী অনেক আগে থেকে সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে এই চ্যানেলটি পক্ষপাতমূলক কার্যক্রমে লিপ্ত। উস্কানিমূলক ও বিতর্কিত সংবাদ পরিবেশনের জন্য ২০১৭ সালের মে মাসের শেষ দিকে আল জাজিরার ওয়েবসাইট ব্লক করে দেয় সৌদি আরব, আরব আমিরাত, মিশর এবং বাহরাইন। ২০১৯ সালে তিনজন ব্যক্তির গুম হওয়ার সাথে বাংলাদেশের একজন উর্দ্ধতন নিরাপত্তা ও সামরিক কর্মকর্তার যোগসাজশ নিয়ে মিথ্যা প্রতিবেদন প্রকাশ করে এই ওয়েবসাইটটি। আসলে এই মিডিয়ার বিরুদ্ধে ক্রমাগত সন্ত্রাসবাদে পৃষ্ঠপোষকতা ও মদদ দানের অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া অনেক দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে আপত্তিকর সংবাদ পরিবেশনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তারা। ফলে দেশে দেশে নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হয়েছে, বিভ্রান্তিতে পড়েছে জনগণ।
আল জাজিরার সাইকোপ্যাথ প্রলাপের কাহিনি ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার’স মেন’-এ গোপন করা হয়েছে অনেককিছু। যেমন, একসময়ের বিরোধীদলীয় নেত্রী এবং বর্তমানের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য যে সন্ত্রাসীরা ১৯৮১ সালের ১৭ মে পরবর্তীতে মাঠে নেমেছিল এবং সক্রিয় ছিল বিভিন্ন অপকর্মে তাদের সম্পর্কে কিছু না বলে একতরফাভাবে একজন সন্ত্রাসীর মৃত্যুর দায় চাপানো হয়েছে সেনাপ্রধানের তিন ভায়ের ওপর। ফ্রিডম পার্টির ভাড়াটিয়া সেই সন্ত্রাসীর সকল পরিচয় গোপন রেখে হারিসের লাইসেন্স করা পিস্তল দিয়ে তাকে গুলি করা হয়েছে বলে দেখানো হয়েছে। মৃত্যুর আগে দিয়ে যাওয়া ওই সন্ত্রাসীর জবানবন্দি থেকে বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় এবং মামলার রায় হয়ে সেনাপ্রধানের এক ভাই জেলও খাটেন। মনে রাখতে হবে সেনাপ্রধানের ভাইরা শেখ হাসিনার পাশে থেকে সন্ত্রাসীদের হামলা থেকে তাঁকে রক্ষা করলেও ১৯৯৬ কিংবা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসীন হয়ে শেখ হাসিনার তরফ থেকে সেই মামলাটি প্রত্যাহার করা হয়নি। বরং আইন তার নিজস্ব গতিতে চলেছে। খুনের দায়ে জোসেফের যাবজ্জীবন সাজা পাওয়া এবং ২০ বছর জেল খেটে রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমায় কারামুক্ত হওয়া অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। ফুটেজে জেলবন্দি খালেদা জিয়াকে দেখানো হয়েছে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক শত্রু হিসেবে, তাকে যে দুর্নীতির মামলায় গ্রেফতার এবং সাজা দেওয়া হয়েছে সেই তথ্য গোপন করা হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার জন্য ইসরায়েলি পণ্য ক্রয়ের বিষয়টি উপস্থাপন করা হয়েছে মৌলবাদীদের উস্কানি দেওয়ার জন্য। অথচ সকলেই জানেন যে, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে লেভেল পরিবর্তন করে তৃতীয় দেশ হয়ে সেখানকার পণ্য সবসময়ই ভারত-বাংলাদেশে আসাটাই স্বাভাবিক। এভাবে মিথ্যাচারের চিত্ররাশিতে ঠাসা ভিডিওটি।
মনে রাখা দরকার, একসময় প্রতিবেদনের পর প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলে দেশ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে পতিত হবে বলেও তথ্য উপস্থাপন করে আল জাজিরা। সেসময় বিশ্বের কাছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে প্রহসন হিসেবে উপস্থাপন করেছিল এবং একাত্তরের কুখ্যাত ও চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের ইসলামী চিন্তাবিদ সাজিয়ে তাদের ভাবমূর্তি তৈরির একটি চেষ্টা দেখা গিয়েছিল। ২০১১ সালের ১০ আগস্টে এক প্রতিবেদনে বলা হয়nqÑ ‘It is the first time in the country`s history that evidence of war crimes will be brought before a judge, but there are accusations that the government is using the trials to round up the opposition’. ২০১৩ সালের ২৫ অক্টোবর ‘দি পলিটিকালাইজেশন অব বাংলাদেশস ওয়ার ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল’ শীর্ষক প্রতিবেদনে তালহা আহমেদ নামের একজন প্রতিবেদক বাংলাদেশের চলমান যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হিসেবে উপস্থাপনের অপচেষ্টা করেন। আল জাজিরা টেলিভিশন তথা মিডিয়ার সম্পর্ক এদেশের জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে। যে দলটি মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধাচারণ করে এসেছে এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দৃষ্টিতে এ দলটি অপরাধী। আল জাজিরার আরও বেশ কয়েকটি প্রতিবেদনে জামায়াতের পক্ষে সাফাই গাওয়া হয়। বিশেষ করে ‘বাংলাদেশ পলিটিশিয়ান অ্যাকিউজড অফ ওয়্যার ক্রাইম’ শীর্ষক প্রতিবেদনে প্রতিবেদক যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের পক্ষে সাফাই গেয়েছিল। ২০১৪ সালে আমরা দেখেছি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ধারাবাহিক নেতিবাচক সংবাদ পরিবেশন করেছিল কাতারি রাজ পরিবারের মালিকানাধীন এই টেলিভিশন চ্যানেলটি। তখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সংক্রান্ত যে কোনো সংবাদ উপস্থাপনের ধরন দেখে মনে হয়েছিল তাদের মূল উদ্দেশ্যই ছিল বিচারপ্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। সেই অপপ্রচারের মাত্রা এখন বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে কেন্দ্র করে ডাল-পালায় বিস্তার লাভ করেছে। যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলীর মৃত্যুদণ্ডের রায়ের পরও আল জাজিরার ভূমিকা ছিল ন্যক্কারজনক। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হিসেবে উপস্থাপন করা হয় একটি অনুষ্ঠানে যেখানে টবি ক্যাডম্যান এবং ডেভিড বার্গম্যান উদ্দেশ্যমূলকভাবে দর্শকশ্রোতার মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ায়। এমনকি যুদ্ধাপরাধী মো. কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ডের চূড়ান্ত রায়ের পর ‘বাংলাদেশ পার্টি চিফ টু হ্যাং ফর ওয়ার ক্রাইমস’ শিরোনামে এক সম্প্রচারে ৩০ লক্ষ মানুষের শহীদ হওয়ার বিষয়টি নিয়ে ব্যঙ্গ করে বলা হয় ইতিহাসবিদদের হিসাবে মুক্তিযুদ্ধে ৩ থেকে ৫ লাখ মানুষ মারা গেছে। আল-জাজিরাকে জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র হিসেবে কাজ করতে দেখা গেছে। যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে প্রচারণায় অংশ নিয়েছিল। এখনও এখানকার অপরাধীদের সুরে সুর মিলিয়ে কথা বলে এই চ্যানেলটি। আল জাজিরা জঙ্গিবাদকে উস্কে দিয়েছে এবং ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনকারীদের যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষের শক্তি বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। এভাবে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে সকল শুভপ্রয়াসের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল আল জাজিরা। কেবল এই ইস্যু নয় আরো অনেক বিষয়ে তাদের নাক গলাতে দেখা গেছে।
২০১১ সালের জানুয়ারিতে সাভারের একটি ইটভাটা থেকে শিশু ও নারীসহ শেকলবন্দী ৩০ জনকে উদ্ধার করে র্যাব। সে সময় দেশ-বিদেশি মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার হয়েছিলো ওই ঘটনা। কিন্তু উদ্দেশ্যমূলকভাবে দুই মাস পর পুনরায় ভিডিও চিত্রসহ ওই ঘটনা নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করে আল জাজিরা। আল জাজিরার ওয়েবসাইটের এশিয়া বিভাগের “হোয়াট’স হট” অংশে গুরুত্বের সঙ্গে ২০১১ সালের ২৬ জানুয়ারির ওই ঘটনাটির ভিডিওচিত্র প্রচার করা হয় ‘পুলিশ রেইড বাংলাদেশ স্লেভ ক্যাম্প’ শিরোনামে। শ্রমিকদের নির্যাতনের যে চিত্র উপস্থাপন করা হয়েছিল তা ছিল অতিরঞ্জিত। মূলত শেখ হাসিনা সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করাই তাদের একমাত্র কাজে পরিণত হয়েছে। বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ণ করার হীন প্রয়াস এখনও চলছে। এর আগেও একাধিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে গুম বেড়েছে বলে প্রচার করা হয় যা ছিল ভিত্তিহীন। ‘র্যাব’ও তাদের টার্গেটে পরিণত হয়েছিল। টিভি চ্যানেলটি বিএনপি-জামায়াতের পক্ষাবলম্বী হওয়ায় বাংলাদেশের এলিটফোর্সকে নিয়ে তারা একাধিক প্রতিবেদন প্রচার করে। ‘ফোর্সড ডিজঅ্যাপেয়ারেনসেস সার্জ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদনের লেখক ছিলেন ডেভিড বার্গম্যান। এই লেখকও বিতর্কিত ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল।
আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের ইতিহাসে অপসাংবাদিকতার নাম আল জাজিরা। এমনকি মিশরে বর্তমানে নিষিদ্ধ ঘোষিত উগ্রপন্থি সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুডের পক্ষে সংবাদ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছিল এই টিভির সাংবাদিকদের। ফলে একাধিক সাংবাদিক চাকরি ছেড়ে দেন। এই চ্যানেলটির বিরুদ্ধে মিশর ও অন্য আরব দেশগুলো নিয়ে গোপন তৎপরতার কথাও জানা গেছে একাধিক সূত্রে। ২০১৪ সালে দোহায় আল জাজিরার সম্পাদকীয় বোর্ড থেকে পদত্যাগ করেন চার সদস্য। মিশর নিয়ে আল-জাজিরার ‘পক্ষপাতমূলক সম্পাদকীয় নীতি’কে নিজেদের পদত্যাগের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন তারা।
পশ্চিমা বিশ্বেও এই টেলিভিশন চ্যানেলটিকে দেখা হয় সন্ত্রাসমূলক কর্মকাণ্ডের পরোক্ষ কিংবা কখনও প্রত্যক্ষ মদদদাতা হিসেবে। এজন্য যুক্তরাষ্ট্রে এর জনপ্রিয়তা একেবারে তলানিতে পৌঁছেছে। বলা হয়ে থাকে, এর রয়েছে টেররিস্ট নেটওয়ার্ক৷ আল জাজিরার বিরুদ্ধে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের সরকার ব্যবস্থা নিয়েছে। উস্কানিমূলক সংবাদ প্রচারের কারণে ২০১০ সালে আল জাজিরা টেলিভিশনের কুয়েত শাখার কার্যালয় বন্ধ করে দেয় সেখানকার সরকার। এর আগেও একবার ২০০২ সালের নভেম্বরে আল জাজিরা কার্যালয় বন্ধ করে দিয়েছিল কুয়েত সরকার। দীর্ঘ আড়াই বছর পর ২০০৫ সালের মে মাসে কার্যালয়টি পুনরায় চালুর অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। মিথ্যা সংবাদ পরিবেশনের অভিযোগে আল-জাজিরার একাধিক সাংবাদিককে কারাদণ্ড দেয় মিশরের আদালত। অভিযুক্ত সকলেই জঙ্গি সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুডের সমর্থন ও মিথ্যা সংবাদ পরিবেশনের অভিযোগে দোষী ছিল। ২০১৫ সালে ‘মিথ্যা সংবাদ ছড়ানোর’ অভিযোগে আল জাজিরার তিনজন সাংবাদিককে দোষী সাব্যস্ত করে মিশর। ২০০২ সালে আল জাজিরায় সৌদিদের ফিলিস্তিন-ইসরায়েল শান্তি পরিকল্পনার কভারেজ নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে কাতার থেকে রাষ্ট্রদূতকে ফিরিয়ে নেয় সৌদি আরব। ২০০৮ সালে রাষ্ট্রদূতকে ফেরত পাঠানো হয়।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, সাংবাদিকদের হলুদ সাংবাদিকতায় বাধ্য করা, জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগ করার নির্দেশ এবং অনৈতিকভাবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা ইত্যাদি অভিযোগ এনে আল জাজিরার ব্যুরো প্রধান মোহাম্মদ ফাহমিসহ মিশরে ২২ জন সাংবাদিক পদত্যাগ করেন। একই অভিযোগ এনে এবং জাজিরাকে অপপ্রচারের মেশিন হিসেবে অভিহিত করে পদত্যাগ করেন লিবিয়া প্রতিনিধি আলী হাশেম, বার্লিন প্রতিনিধি আখতাম সুলেমান। ধর্মীয় উস্কানি, জিহাদের অপব্যাখ্যা দিয়ে উগ্রবাদী ধারণা প্রচার, জঙ্গিদের দেশপ্রেমিক হিসেবে আখ্যা দেয়া, বোমা হামলা ও আত্মঘাতী হামলাকে জান্নাতের সফর বলে উল্লেখ করাসহ নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে বিতর্কিত অনুষ্ঠান প্রচারের কারণে বিশ্বে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে এই মিডিয়া।
মূলত আল জাজিরা আরববিশ্বের কলঙ্ক। পৃথিবীর মানুষ যেখানে শান্তির পক্ষপাতী সেখানে একটি টিভি চ্যানেল রাতদিন ২৪ ঘণ্টা সম্প্রচার করে চলেছে অশান্তির বার্তা। এই মিডিয়ার সকল কার্যক্রম সম্পর্কে আমাদের সচেতন ও সতর্ক থাকা অতিজরুরি। গণতন্ত্র ও মানবতাকে রক্ষা করতে হলে আল জাজিরার বিরুদ্ধে কথা বলতেই হবে। জনৈক সাইকোপ্যাথের জবানিতে বর্ণিত ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার’স মেন’ তথ্যচিত্রের মিথ্যাচার শেখ হাসিনা সরকারের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না বলে আমরা মনে করি। সকল ষড়যন্ত্রের জাল ছিঁড়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই বাংলাদেশ উন্নয়নের শিখরে আরোহিত হবে।
(লেখক: ড. মিল্টন বিশ্বাস, ইউজিসি পোস্ট ডক ফেলো এবং বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, [email protected])
সূত্র : বাংলা ইনসাইডার