যদি গাজায় চলমান যুদ্ধটি বাকি সব যুদ্ধগুলোর মত হতো তাহলে এত দিনে হয়তো সেখানে অনেক কিছুর ক্ষেত্রে আলাদা চিত্র দেখা যেতো।
সম্প্রতি সেখানে যুদ্ধবিরতি হয়েছে। কিন্তু তখন হয়তো বহুদিন আগেই এই যুদ্ধবিরতি হতো।
মৃতদের কবর দেয়া হয়ে যেত এবং ইসরায়েলকে হয়তো জাতিসংঘের সাথে তর্ক করতে হতো যে গাজার পুননির্মাণে ঠিক কী পরিমাণ সিমেন্টের দরকার হবে।
কিন্তু এই যুদ্ধটা সেগুলোর মতো নয়।
কারণ এখানে যে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চলছে শুধু সেটাই একমাত্র কারণ নয়।
এখানে হত্যাযজ্ঞের শুরুটা করেছিল হামাস গত ৭ই অক্টোবর, বেশিরভাগ ইসরায়েলি বেসামরিক নাগরিকদের ওপর। তারপর ইসরায়েল পাল্টা আক্রমণ শুরু করে যাকে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু অভিহিত করেছেন ‘ভয়ংকর প্রতিশোধ’ হিসেবে, সেখানেও বেশিরভাগ ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিক হত্যার শিকার হয়েছেন।
এই যুদ্ধটা অন্যগুলো থেকে ভিন্ন কারণ এটা এমন সময় হচ্ছে যখন মধ্যপ্রাচ্যকে ভাগ করা ফল্ট লাইনে চিড় ধরেছে।
গত দুই দশক ধরে এখানকার ভূ-রাজনীতির যে উত্তেজনাকর চিত্র, তার একদিকে ইরান এবং তার বন্ধু ও মিত্ররা, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার বন্ধু ও মিত্ররা।
ইরানের এই নেটওয়ার্কের মূলে, যেটা কখনো পরিচিত ‘প্রতিরোধের জোট’ হিসেবে, সেই দলে রয়েছে লেবাননের হেজবুল্লাহ, সিরিয়ার আসাদ সরকার, ইয়েমেনের হুতি এবং ইরাকের সশস্ত্র বাহিনী যাদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে ইরান। ইরানিরা গাজায় হামাস এবং ইসলামিক জিহাদকেও সমর্থন দিয়ে আসছে।
একই সঙ্গে ইরান এখন চীন এবং রাশিয়ারও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছে। ইউক্রেনে রাশিয়া যে যুদ্ধ পরিচালনা করছে ইরান সেটার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আর চীন ইরানের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ তেল কিনে থাকে।
গাজায় যুদ্ধ যত দীর্ঘ হবে এবং ইসরায়েল যত বেশি ফিলিস্তিনি বেসামরিক লোক হত্যা করবে ও হাজার হাজার বাড়িঘর ধ্বংস করবে, ততই এই দুই মিত্র গোষ্ঠীর কোন কোন সদস্যের মধ্যে সংঘাতের ঝুঁকি তৈরি হবে।
ইসরায়েল আর লেবাননের সীমান্তে ধীরে ধীরে উত্তেজনা দানা বাঁধছে। ইসরায়েল বা হেজবুল্লাহ কোন পক্ষই অবশ্য সরাসরি যুদ্ধ চায় না। কিন্তু যেহেতু দু’পক্ষ থেকেই উত্তজনা ক্রমে বেড়ে চলেছে, তাই সেটা কোন এক সময় অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ার ঝুঁকিটাও তৈরি হয়।
ইয়েমেনের হুতিরা ইসরায়েলের দিকে তাক করে মিসাইল ও ড্রোন হামলা ছুঁড়েছে। সে সবগুলোই অবশ্য প্রতিহত করেছে ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং রেড সি‘তে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের নৌবহর।
ইরাকে, ইরান সমর্থিত সশস্ত্র বাহিনী মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা করেছে। যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় তাদের কিছু অবস্থান থেকে সরে এসেছে।
যদিও সবপক্ষই উত্তেজনা যাতে খুব বেশি না ছড়ায় সেই চেষ্টা করছে, কিন্তু সামরিক শক্তি প্রয়োগের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা সবসময়ই কঠিন।
যুক্তরাষ্ট্রের দিকে আছে ইসরায়েল, উপসাগরীয় তেল সমৃদ্ধ রাষ্ট্রগুলো, জর্ডান ও মিসর।
যুক্তরাষ্ট্র শুরু থেকেই ইসরায়েলকে জোরালো সমর্থন দিয়ে আসছে, যদিও এটা পরিষ্কার যে ইসরায়েল যে ব্যাপক পরিমাণে ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিক হত্যা করছে, সেটা নিয়ে অস্বস্তি আছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনেরও।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন প্রকাশ্যেই বলেছেন যে অনেক বেশি ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিক নিহত হচ্ছে।
উত্তর গাজা থেকে হাজারে হাজার ফিলিস্তিনের পালিয়ে প্রধান সড়ক দিয়ে হেঁটে দক্ষিণে যাওয়ার যে দৃশ্য সেটা অনেককেই ১৯৪৮ সালে আরবদের বিপক্ষে ইসরায়েলের স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়ের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।
যে সাত লাখেরও বেশি মানুষ ইসরায়েলি বাহিনীর অস্ত্রের মুখে তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছে সেটাকে ফিলিস্তিনিরা আল নাকবা বা মহাবিপর্যয়ের সঙ্গেও তুলনা করছে। সেই ১৯৪৮ সালের শরণার্থীদের পরের প্রজন্মের বেশিরভাগই এখন গাজা উপত্যকার বাসিন্দা।
আর কিছু উগ্র ইহুদী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী, যারা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সমর্থক, তাদের অনেকের ফিলিস্তিনিদের উপর আরেকটি নাকবা আরোপের মতো ভয়ংকর কথাবার্তা, যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র শিবিরেরই কিছু আরব দেশ বিশেষ করে জর্ডান ও মিশরকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।
এমনকি নেতানিয়াহু সরকারের একজন মন্ত্রী তো হামাসকে মোকাবেলা করার জন্য গাজায় পারমাণবিক বোমা ফেলার ইঙ্গিতও দেন। তাকে তিরস্কার করা হলেও বহিষ্কার করা হয়নি।
এসবকে পাগলের আলাপ বলে উড়িয়ে দেয়া যেতে পারে কিন্তু জর্ডান ও মিশরটা বিষয়টা গুরুত্বসহকারেই নিয়েছে।
সেটা অবশ্য পারমাণবিক বোমার ব্যাপারে না হলেও, যেটা ইসরায়েলের ঘোষিত ও অঘোষিত অনেকই আছে, বরং হাজার হাজার ফিলিস্তিনির তাদের সীমানায় ঢুকে পড়ার শঙ্কা তাদের বেশি।
আর যদি গাজায় যুদ্ধের কথা বলা হয়, তাহলে বিভিন্ন পশ্চিমা দেশের উচ্চপদস্থ কূটনীতিকরা বিবিসিকে বলেছেন, যুদ্ধ এবং তার পরবর্তি পরিস্থিতি মোকাবেলা করা হবে খুবই ‘কঠিন এবং বিশৃঙ্খল’।
একজন বলেছেন যে, ‘একমাত্র রাস্তা হবে ফিলিস্তিনের জন্য একটা রাজনৈতিক দিগন্ত পুনর্নির্মাণ করা।’ তিনি মূলত ইসরায়েলের পাশাপাশি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে ইঙ্গিত করেছেন, তথাকথিত ‘টু-স্টেট’ সমাধান, যা ব্যর্থ হয়ে এখন শুধু স্লোগানেই টিকে আছে।
সেটাকে পুনরুজ্জীবিত করা, ইসরায়েল ও আরবের মধ্য থেকে তাদের জায়গা বের করা খুবই উচ্চভিলাষী পরিকল্পনা এবং একই সাথে সম্ভবত বর্তমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে ভালো সমাধানও।
কিন্তু বর্তমানে যে বেদনা, ঘৃণা আর শঙ্কার পরিবেশ চলমান সেখানে এই ধারণার প্রয়োগ করা হবে খুবই কঠিন কাজ।
আর বর্তমান ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি যে নেতৃত্ব তাদের অধীনে এটা অসম্ভব।
প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু গাজায় যুদ্ধ সমাপ্তির পর কি হবে সেই পরিকল্পনা এখনো প্রকাশ করেননি।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের যে প্রস্তাব, সেখানে বর্তমান প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সরকার সমর্থিত একটা প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা, যাদের হামাস ২০০৭ সালে বিতাড়িত করেছিল, সেটিকে প্রত্যাখান করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনার দ্বিতীয় অংশ হল দুই রাষ্ট্রের সমাধান নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া, যেটি নেতানিয়াহু তার পুরো রাজনৈতিক জীবনজুড়ে বিরোধিতা করে এসেছেন।
ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার বিপক্ষে শুধু নেতানিয়াহুই নন।
তিনি যাদের সমর্থনে আবারও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে এসেছেন সেই গোঁড়া ইহুদী জাতীয়তাবাদী যারা তাদের বিশ্বাস, জর্ডান নদী আর ভূমধ্যসাগরের মাঝখানের যে অঞ্চল সেটা পুরোটাই ইহুদীদের জন্য ঈশ্বরের দান এবং তার ইসরায়েলের সীমানার ভেতরেই থাকতে হবে।
ইসরায়েলের ভেতরে অনেকেই ৭ই অক্টোবরের হামলার জন্য নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা ব্যর্থতায় নেতানিয়াহুকে দায়ী করে তার পদত্যাগ চান।
ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের বয়স ৮০ পেরিয়ে গিয়েছে, ভোটারদের কাছেও তার সমর্থন এখন কম, যদিও ২০০৫ সাল থেকে তিনি ব্যালট বাক্স ছাড়াই ক্ষমতায়।
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ পশ্চিম তীরে নিরাপত্তার জন্য ইসরায়েলকে সহায়তা করে আসছে কিন্তু তাদের নিজেদের লোকদেরই বসতি স্থাপনকারী অস্ত্রধারী ইহুদীদের থেকে রক্ষায় ব্যর্থ।
একসময় নেতৃত্বের বদল ঘটবে। কিন্তু যদি গাজার এই মর্মান্তিক যুদ্ধ ইসরায়েল, ফিলিস্তিন ও তাদের শক্তিশালী বন্ধুদের শান্তি স্থাপনে বাধ্য না করে, তাহলে ভবিষ্যতে আরও যুদ্ধই অপেক্ষা করছে।
খবর বিবিসি