মেঠো পথের ভোরে হালকা কুয়াশা। সূর্যোদয়ের মুহূর্তে মৃদু হাওয়া। এরপর কাঠফাটা রোদ। কখনো আবার পরক্ষণেই ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টিও এদিকে আছে, তো ওদিকে নেই। ‘ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া’ বাইরে গেলে কখনও স্বেদে সিক্ত, আবার কখনও বৃষ্টিস্নাত। এই তো শরতের রূপ।
সোমবার (১৬ আগস্ট) পহেলা ভাদ্র। গ্রীষ্ম-বর্ষা পেরিয়ে যাত্রা শুরু করলো শ্বেত-শুভ্র ঋতু শরৎ। যে ঋতুতে আকাশ দেখে চট্ জলদি মন ভালো হয়ে যায়। ঝকঝকে কাচের মতো স্বচ্ছ নীলাকাশ, পেঁজা তুলার মতো সাদা মেঘমালা। আবার মুখ গোমড়া কালো মেঘের ছায়া।
শরতকে বন্দনা করতে কবিগুরু সেই কবে গুনগুনিয়ে উঠেছিলেন— ‘আজি কি তোমার মধুর মুরতি/হেরিনু শরৎ প্রভাতে হে মাতা বঙ্গ-শ্যামল অঙ্গ ঝরিছে অনল শোভাতে…’।
আর শরতের ময়ূরকণ্ঠী নির্মল নীল আকাশে শিমুল তুলোর মতো শুভ্র মেঘেদের ছুটে বেড়ানো দেখে লিখেছিলেন— ‘অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া…’। শতবর্ষ আগে কবিগুরু এমন আবেগে শরতের আগমনী বার্তা বর্ণনা করেছেন; কিন্তু মনে হয় যেন সেদিনের কথা। আজও কী টগবগে তাজা!
আষাঢ়-শ্রাবণ শেষে ভাদ্রে আসে শরৎকাল। সঙ্গে থাকে আশ্বিন মাস। এতো গেলো বঙ্গাব্দের হিসাব, খ্রিস্টাব্দের হিসাবে মধ্য আগস্ট থেকে মধ্য অক্টোবর পর্যন্ত শরৎ ঋতুর পথচলা। সাদা কাশফুল, শিউলি, স্নিগ্ধ জ্যোত্স্না, আলোছায়ার খেলা দিনভর— এসব মিলেই তো শরতের ছুটে চলা। শরতের স্নিগ্ধতা এক কথায় অসাধারণ! জলহারা শুভ্র মেঘের দল যখন নীল, নির্জন, নির্মল আকাশে ভেসে বেড়ায় তখন আমরা বুঝতে পারি শরৎ এসেছে। শরতে চলে আলো-ছায়ার খেলা; এই মেঘ, এই বৃষ্টি, আবার এই রোদ।
প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ এ ঋতুর চরিত্রের সঙ্গে বর্ণনা করেছেন প্রিয়তমাকে। তিনি তার ‘এখানে আকাশ নীল’ কবিতায় লিখেছিলেন ‘এখানে আকাশ নীল—নীলাভ আকাশজুড়ে সজিনার ফুল/ ফুটে থাকে হিম শাদা—রং তার আশ্বিনের আলোর মতন’।
শরতের অন্যতম আকর্ষণ কাশফুল! নদী তীরে বনের প্রান্তে কাশফুলের রাশি অপরূপ শোভা ছড়ায়। কাশফুলের এ অপরূপ সৌন্দর্য পুলকিত করেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। গাছে গাছে শিউলির মন ভোলানো সুঘ্রাণে অনুভূত হয় শরতের ছোঁয়া।
অনেকের মতে, শরৎকালে নাকি ভালোলাগার অনুভবে মনটা নেচে ওঠে। ছুটির নেশা, উত্সবের নেশায় মন ছুটে যায়। কারণ, এ শরৎকালে মাঠে মাঠে সবুজ ধানের ওপর সোনালি আলোর ঝলমলে রূপ দেখা যায়। প্রতীক্ষায় থাকে কৃষকরা। আসন্ন নবান্নের আশায়।
আলোক-শিশিরে-কুসুমে-ধান্যে বাংলার প্রকৃতিও খুশি। আর বাঙালির সেই প্রাণের উত্সবটা তো রয়েছেই— শারদীয় দুর্গাপূজা। শরৎ শারদীয় আরাধনায় হিন্দু সমাজকে উৎবমুখর করে, বিজয়ার বেদনায় করে ব্যথিত।
ব্যস্ত এ নগরীতে, করোনার দহনকালে আসুন হারিয়ে যাই— শরতের কাশফুল, গোধূলি, শিউলি আর জ্যোৎস্নার মধ্যে। প্রিয়জনের হাত ধরে অনুভব করি শরতের স্নিগ্ধতা।