দেশের মানুষ ও সরকারের শিথিলতায় করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ছে। এ অবস্থায় মাস্ক ও স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে কঠোর না হলে ভয়াবহ বিপদ ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী।
ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, আমাদের দেশে যখন করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ কমে গিয়েছিল, তখন প্রয়োজন ছিল স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে জোর দেওয়া। কিন্তু তখন আমরা দেখলাম সাধারণ মানুষ যেমন অসতর্ক হয়ে গেলো, তেমনি কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকেও এক ধরনের অবহেলা ও শৈথিল্য দেখা দিলো। ফলে মানুষজন মনে করলো, এখন যা ইচ্ছা তাই করা যাবে, দলবেঁধে কক্সবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে বেড়াতেও যাওয়া যাবে। এটা করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ার একটা কারণ। ‘দ্বিতীয় আরেকটি কারণ হচ্ছে, টিকা নেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা অযথা কিছু জটিলতা তৈরি করে মানুষকে উৎসাহিত করতে পারিনি। যেমন অনলাইনে নিবন্ধন, প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের কতভাগ মানুষ প্রযুক্তিবান্ধব, কতভাগ মানুষের কাছে অ্যান্ড্রোয়েড মোবাইল ফোন আছে? কতজন মানুষ গ্রাম থেকে ইউনিয়ন পরিষদ বা উপজেলায় গিয়ে নিবন্ধন করতে পারবে? এসব না ভেবে বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কহীন ধারণায় পরিচালিত হয়ে টিকার নিবন্ধন অনলাইনে করলাম। ফলে দেখা যাচ্ছে যতই দিন যাচ্ছে টিকা গ্রহণ করা মানুষের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এটাও সংক্রমণ বাড়ার আরেকটা কারণ।
তৃতীয় কারণ হচ্ছে, ব্রিটেনে যখন করোনা ভাইরাসের ‘ইউকে ভ্যারিয়েন্ট’ দেখা দিলো, তখন আমাদের উচিত ছিল দেশে কোয়ারেন্টিন এবং করোনা প্রতিরোধ কার্যক্রম জোরদার করা। সেখানেও আমরা অবহেলা দেখালাম। প্রথমে ৭ দিন কোয়ারেন্টিন করা হলো, পরে সেটাকে আবার ৪ দিনে নামিয়ে আনা হলো। এরপর আবার ৭ দিন প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন এবং ৭ দিন হোম কোয়ারেন্টিন করা হলো।
তিনি বলেন, বাস্তবতা হচ্ছে, হোম কোয়ারেন্টিন বাংলাদেশের মানুষ পালন করে না এবং হোম কোয়ারেন্টিন পালন করার মতো অবকাঠামোগত সুবিধাও আমাদের সব বাড়িতে নেই। ফলে হোম কোয়ারেন্টিন তারা মানেনি। ফলে আমাদের দেশে ইউকে ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে যাওয়ার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল, যেটা আমরা থামাতে পারিনি।
‘এছাড়াও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে যেসব লোক দেশে এসেছিল, তাদের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কিনা, তা আমাদের জানা নেই। ধারণা করা হয় যে, তাদের ক্ষেত্রেও ঢিলেঢালা ভাব ছিল। ফলে অতি সংক্রমণশীল ভ্যারিয়েন্টগুলো বাংলাদেশে ছড়াতে পেরেছে। ’
ডা. লেলিন বলেন, পাশাপাশি করোনা ভাইরাসের গতি এবং প্রকৃতি বোঝার জন্য নিয়মিত যে করোনা ভাইরাসের জিন বিন্যাস করা দরকার, সেক্ষেত্রেও আমরা দেখেছি আইইডিসিআর যথেষ্ট টাকা-পয়সার অভাবে এই কাজ ঠিকমতো করতে পারেনি।
যখন দেশে করোনা ভাইরাস কমতে শুরু করেছিল, তখন আমরাও প্রতিরোধমূলক কার্যক্রমগুলোও কমাতে শুরু করেছি। যার অনিবার্য ফল হিসেবে আমরা বর্তমানে একটা ভয়াবহ বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছি। একইসঙ্গে এখন আমাদের যে কাজগুলো করা দরকার সেগুলো আমরা এখন করছি না।
বর্তমান সময়ে আমাদের করণীয় বিষয় সম্পর্কে জানতে চাইলে এ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, করোনা প্রতিরোধে এখন প্রধান কাজ হচ্ছে মানুষকে মাস্ক পরতে এবং করোনার স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করার জন্য আইনের কঠোর প্রয়োগ। সেটা এখনও আমরা শুরু করিনি। ‘আরেকটি বিষয় ভিড় এবং জনসমাগম হয় এমন বিষয়গুলো আমরা এখনও বন্ধ করিনি। আমরা দেখছি এখনও মেলা হচ্ছে, সরকারি-বেসরকারি, সামাজিক-রাজনৈতিক-ধর্মীয় সভা সমাবেশ কোনোকিছুই স্থগিত করা হয়নি। মার্কেটগুলোতেও লোকজন অবাধে যাতায়াত করছে। গণপরিবহনেও কোনো সতর্কতা নেই। সরকার বলছে করোনা নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মানতে হবে, কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মানানোর জন্য যে কাজগুলো করা দরকার, তার কোনোকিছুই করা হচ্ছে না। ’
তিনি আরও বলেন, গতকাল শনাক্তের যে সংখ্যা ছিল, এটাই কিন্তু বাস্তব চিত্র না। যারা রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করছেন, তাদের প্রতি তিনদিন পর পর করোনা ভাইরাসের পরীক্ষা করা হয়। এই সংখ্যাও কয়েক হাজার। যারা বিদেশ যাচ্ছে সেই সংখ্যাও কম না। এদের বাদ দিয়ে সঠিক রোগের জন্য যে পরীক্ষাগুলো করা হচ্ছে, সেটা এখন ২০ শতাংশের কাছাকাছি সংক্রমণ চলে গেছে বলে আমার ধারণা। এর অর্থ হচ্ছে আমরা এখন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে রয়েছি।
ডা. লেলিন বলেন, আমরা এখনই যদি করোনা ভাইরাসের রাশ টেনে ধরতে না পারি, তাহলে আমাদের অনেক জীবন দিয়ে, অর্থ দিয়ে, স্বাস্থ্য, ভোগান্তি এবং জাতীয় অর্থনীতির বহু ক্ষতি দিয়ে আমাদের সেই দায় শোধ করতে হবে।