বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা রেখে আটকে গেছে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে মূল টাকা তো ফেরত আসছেই না, আবার সময়মতো সুদও পাওয়া যাচ্ছে না। এ রকম দুরবস্থার মধ্যেও রিলায়েন্স ফাইন্যান্সে নতুনভাবে ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে ব্যাংকটি।
সব মিলিয়ে বর্তমানে সাতটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কমার্স ব্যাংকের ৭০৯ কোটি টাকা আটকে গেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে সুদ পাওনা রয়েছে আরও ৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বহুল আলোচিত প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারের সংশ্লিষ্টতা ছিল, এমন প্রতিষ্ঠানের ঋণই ৬৮৯ কোটি টাকা। এভাবে ভুল পথে পরিচালনার কারণে তিন বছর ধরে লোকসান গুনছে কমার্স ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিদর্শন প্রতিবেদনে এসব অনিয়মের বিষয় উঠে এসেছে। এ নিয়ে ব্যাংকটিকে সতর্ক করার পাশাপাশি ব্যাখ্যাও চেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কমার্স ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গত বছর শেষে সাত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে তাদের পাওনার পরিমাণ ৭১০ কোটি টাকা। অবশ্য উচ্চ সুদের লোভেই ব্যাংকটি ওই টাকা বিনিয়োগ করেছিল, যা এখন সময়মতো ফেরত পাচ্ছে না। এমনকি সুদও নয়।
পি কে হালদার যে রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের (বর্তমানে আভিভা ফাইন্যান্স) এমডি ছিলেন, সেটির কাছে কমার্স ব্যাংকের আটকে আছে ২৯১ কোটি টাকা। আর পি কে হালদারের বেনামি মালিকানাধীন চার আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে আটকে আছে ৩৯৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে পিপলস লিজিংয়ে ১৫৪ কোটি ২৫ লাখ, এফএএস ফাইন্যান্সে ২০ কোটি, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানিতে ৭৬ কোটি ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে ১৪৭ কোটি ৪৯ লাখ টাকা আটকা। সব কটিই পি কে হালদারের প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত। এর বাইরে ফার্স্ট ফাইন্যান্সে ৯ কোটি টাকা ও প্রিমিয়ার লিজিংয়ে ১০ কোটি ৩৪ লাখ টাকা আটকা পড়েছে কমার্স ব্যাংকের। সব কটি প্রতিষ্ঠানই সংকটে পড়েছে, গ্রাহকদের সময়মতো টাকা ফেরত দিতে পারছে না।
আর কিউ এম ফোরকান কমার্স ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) থাকাকালে এসব অর্থ দিয়েছিলেন। এরপরও তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উপরন্তু ব্যাংকিং চাকরি শেষে এখন তিনি কমার্স ব্যাংক সিকিউরিটিজের এমডি পদে আছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অবসায়ন প্রক্রিয়ায় থাকা পিপলস লিজিংয়ের কাছ থেকে টাকা আদায় অনিশ্চিত। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে রাখা স্থায়ী আমানতের মেয়াদও এক বছর পেরিয়ে গেছে। এসব আমানত নবায়নে ব্যাংক ব্যবস্থাপনা ব্যর্থ হয়েছে এবং এসব অর্থ আদায় অনিশ্চিত মর্মে প্রতীয়মান হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, পরিদর্শনের সময় রিলায়েন্স ফাইন্যান্সে আমানতের পরিমাণ ছিল ২৫০ কোটি টাকা এবং এর মেয়াদ ছিল ২০২০ সালের ২০ জুলাই পর্যন্ত। পরিদর্শনের সময় আরোপিত সুদ ছিল ৭ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। সুদ অনাদায়ি থাকা অবস্থায় রিলায়েন্স ফাইন্যান্সে নতুন করে ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়। একই দিনে অনাদায়ি সুদ সমন্বয় করা হয়, যা ব্যাংকিং নিয়মাচারের পরিপন্থী। তখন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) দায়িত্বে ছিলেন জাফর আলম। বর্তমানে তিনি ব্যাংকটির অতিরিক্ত এমডি। এ নিয়ে তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া ব্যাংকটির বর্তমান এমডি ওমর ফারুক এবং সাবেক এমডি আর কিউ এম ফোরকানকেও ফোনে পাওয়া যায়নি। জনসংযোগ কর্মকর্তাকে প্রশ্ন পাঠানো হলেও উত্তর আসেনি।
পিপলস লিজিং ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের টাকা আদায় অনিশ্চিত হওয়ায় ২০১৯ সালেই ব্যাংটিকে এসব বিনিয়োগের বিপরীতে শতভাগ নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখার নির্দেশনা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে করোনাভাইরাসের কারণে গত বছরে অতিরিক্ত নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে পারেনি ব্যাংকটি। এর মধ্যে নতুন করে রিলায়েন্স ফাইন্যান্সকে টাকা দিয়েছে কমার্স ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, এতে ব্যাংকের বিনিয়োগঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়েছে। বিনিয়োগঝুঁকি বৃদ্ধি পেলে আমানত সুরক্ষাঝুঁকিও বাড়াতে হবে।
পি কে হালদারের বেনামি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এফএএস ফাইন্যান্সের এমডি প্রীতীশ কুমার সরকার বলেন, ‘এমনিতেই সমস্যায় আছি। আগে ছোট গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়ার চেষ্টা করছি। এরপরে ব্যাংকগুলোর টাকা ফেরতের চিন্তা।’
এদিকে পরপর তিন বছর লোকসান করেছে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক। ২০১৬ সালে এটির মালিকানা পরিবর্তন হয়। এরপর থেকে সরকারি-বেসরকারি মালিকানায় পরিচালিত এ ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। তা সত্ত্বেও প্রতিনিয়ত জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আবার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সবাই চুক্তিভিত্তিক। ফলে কেউ দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছেন না। এমনকি ব্যাংকটিতে নিয়োগ করা পরিচালকদের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ।
২০১৮ সালে ব্যাংকটি ২৩২ কোটি টাকা ও ২০১৯ সালে ৫২ কোটি টাকা লোকসান দেয়। গত বছর লোকসান ১০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।
ব্যাংকটির কর্মকর্তারা বলছেন, এটি কার্যত কোনো ব্যবসার মধ্যে নেই। ফলে খরচ বাড়লেও আয় বাড়ছে না। এতে দিন দিন সংকট বাড়ছে।
কমার্স ব্যাংকের মালিকানার ৫১ শতাংশ সোনালী, জনতা, অগ্রণী ব্যাংক ও স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে। ২০১৫ সাল পর্যন্ত ব্যাংকটির ৪০ শতাংশ শেয়ার ছিল বিকল্প ধারা বাংলাদেশের মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নান, এমজিএইচ ও আনোয়ার গ্রুপের হাতে। ২০১৬ সালের শুরুতে বেসরকারি সব শেয়ার কিনে নেয় চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপ।
অগ্রণী ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম বলেন, ‘ওই ব্যাংকে আরও অনেকের মালিকানা আছে। সেখানে আমাদের ভূমিকা গৌণ। আমরা চেষ্টা করেছি ব্যাংকটিকে ঠিক করার, তবে পারিনি। দেখব আরও কিছু করার আছে কি না।’