প্রতি বছর পহেলা বৈশাখ ও ঈদ সামনে রেখে বাহারি পোশাকের পসরা সাজিয়ে বসে দেশের ফ্যাশন হাউসগুলো। তবে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে গত বছর বন্ধ ছিল বৈশাখ উদযাপন। ফলে বিকিকিনি করতে পারেননি ব্যবসায়ীরা। এ বছরও পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আউটলেটে তোলা অধিকাংশ পণ্যই অবিক্রিত থেকে গেছে। এ অবস্থায় আসন্ন ঈদে কতটুকু ব্যবসা হবে তা নিয়ে সংশয়ে আছে ফ্যাশন হাউসগুলো।
খাত সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে ২০২০ সালের বৈশাখ ও ঈদে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে ছোট-বড় প্রায় পাঁচ হাজার ফ্যাশন হাউসকে। এবারও সেই অনাকাঙ্ক্ষিত কঠোর বিধিনিষেধের কারণে বৈশাখে হয়নি লক্ষ্যপূরণ। লোকসান হয়েছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা।
আসন্ন ঈদকে ঘিরে দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলো পাঁচ থেকে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। কিন্তু করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় এই লক্ষ্য অর্জন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ২৮ এপ্রিলের পর সর্বাত্মক বিধিনিষেধ যদি আর বাড়ানো নাও হয় তারপরও নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ হয়তো অর্জিত হতে পারে। টাকার অংকে ১৬০০-২২০০ কোটি টাকার মতো বিক্রি হতে পারে। এটিও আবার নির্ভর করছে করোনা পরিস্থিতি ও সরকারের যথাযথ সহযোগিতার ওপর। ফ্যাশন এন্ট্রাপ্রনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের বর্তমান সভাপতি শাহীন আহমেদ ও সাবেক সভাপতি আজহারুল হক আজাদসহ দেশীয় ফ্যাশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যবসায়ীদের বক্তব্যে গত বছরের লোকসান ও এ বছরের আশঙ্কার চিত্র ফুটে উঠেছে।
দেশীয় ব্র্যান্ড সাদা-কালো’র স্বত্বাধিকারী ও ফ্যাশন এন্ট্রাপ্রেনার্স অব বাংলাদেশের বর্তমান কমিটির নির্বাহী সদস্য আজহারুল হক আজাদ বলেন, আমাদের কাছে বৈশাখ ও ঈদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সারা বছরের বেচাকেনার অর্ধেকই এ দুই উৎসবকে ঘিরে হয়। করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকেই আমরা সমস্যায় পড়েছি। গত বছরও বৈশাখের আগে লকডাউন শুরু হয়েছে, এবারও তাই। এটি দুঃখজনক। কারণ এ বিষয়ে সরকারের অনেক আগে থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া দরকার ছিল। গত বছর বৈশাখ ও ঈদে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। এরপর গত এক বছরে স্বাভাবিক অবস্থায় যেতে পারিনি আমরা। হিসাব করলে দেখা যাবে, স্বাভাবিক সময়েও আমরা প্রায় এক থেকে দেড় হাজার কোটি টাকার বাজার হারিয়েছি। এবার ঈদকে ঘিরেও একই অবস্থা দাঁড়িয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বৈশাখকে ঘিরে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা এবং রমজানের ঈদকে ঘিরে আমাদের দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলোর পাঁচ থেকে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ছিল। যার পুরোটাই এখন হুমকির মুখে। ইতোমধ্যে বৈশাখ চলে গেছে, ঈদ বাজারেরও অর্ধেক সময় চলে যাচ্ছে। রোববার (২৫ এপ্রিল) থেকে দোকানপাট খুলবে,কিন্তু বিক্রি খুব বেশি হবে না। কারণ রোজার শেষ দিকে মানুষ বাড়ি যাওয়ার জন্য অস্থির থাকে। ফলে আমাদের হাতে সময় থাকবে খুব কম। এর পাশাপাশি দীর্ঘ সময় লকডাউনে সবার মধ্যে আতংক কাজ করছে। ফলে লকডাউন তুলে নিলেও সবাই বের হবে না। ইতোমধ্যে ৫০ ভাগ লোকসান হয়ে গেছে। সুতরাং ধরে নেওয়া যায় ঈদের বিক্রির যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল তার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পূরণ হতে পারে।
সংগঠনের সভাপতি ও অঞ্জন’সের স্বত্বাধিকারী শাহীন আহমেদ বলেন, সারাদেশে প্রায় পাঁচ হাজার ফ্যাশন হাউস আমাদের সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। গত বছর বৈশাখে তো একেবারেই বেচা-বিক্রি হয়নি। এবার শুরুতে কিছুটা হয়েছিল। ঈদকে কেন্দ্র করে বড় আয়োজন রয়েছে। পরিস্থিতি কিছুটা পরিবর্তন হয়েছিল দেখেই আমরা সেভাবে প্রস্তুতিও নিয়েছিলাম। করোনা সংক্রমণ রোধে সরকারের দেওয়া সর্বাত্মক বিধিনিষেধ চলছে। এখন ঈদে যদি আশানুরূপ বিক্রি না হয়, তাহলে এই খাত আবার বড় রকমের ক্ষতির কবলে পড়বে, যা কাটিয়ে ওঠা সহজ হবে না। এক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্তদের দুই ধরনের প্রণোদনার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলো বাঁচাতে সরকারের কাছ থেকে আমাদের অনেক ক্ষুদ্র ফ্যাশন হাউস প্রণোদনা দাবি করছে। সেক্ষেত্রে আমার সুপারিশ থাকবে দুই ধরনের প্রণোদনার। এক শ্রেণিকে স্বল্প সুদে ঋণ ও বেশি ক্ষতিগ্রস্তদের সরাসরি আর্থিক সহায়তা দেওয়া। কেননা এই খাতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকের সংখ্যা পাঁচ লাখের কাছাকাছি।
শাহীন আহমেদ বলেন, লকডাউন শেষে আউটলেটগুলো খোলার সুযোগ দিলেই হবে না, আমরা চাইব পুরো সময় খোলার সুযোগ। কারণ সীমিত সময়ের জন্য সুযোগ দিলে ক্রেতাদের চাপ বেশি থাকে। সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি রক্ষা করা কঠিন হবে।
সাদা-কালো’র স্বত্বাধিকারী আজহারুল হক আজাদ স্বাস্থ্যবিধি মানতে প্রয়োজনে সেনাবাহিনী ও বিজিবি মোতায়েনের দাবি জানিয়ে বলেন, করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে লকডাউন একমাত্র সমাধান নয়। এ জন্য স্বাস্থ্যবিধি অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। কিন্তু আমরা সেটাতে যথেষ্ট গাফিলতি করেছি। মার্চ থেকে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার তথ্য পেয়েও আমাদের সেরকম প্রস্তুতি ছিল না। বিষয়টি দুঃখজনক। আপনি লক্ষ্য করবেন আমাদের গার্মেন্টস ও কারখানা খোলা রাখা হয়েছে। কারণ দেশের বাইরে এর চাহিদা রয়েছে। তাই অর্ডার রেডি করতে হচ্ছে। তারমানে অধিকাংশ দেশ লকডাউনে যাচ্ছে না। প্রকৃতপক্ষে জীবন ও জীবিকা সমন্বয় করতে হবে। লকডাউন না দিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মানতে প্রয়োজনে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশ মাঠে নামাতে হবে।
এদিকে অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা করোনাকালে ই-কমার্স ব্যবসায় জোর দিচ্ছেন। বর্তমানে ই-কমার্সের আওতায় কাজ করছেন প্রায় সাড়ে চার লাখ অনলাইনভিত্তিক উদ্যোক্তা। ২০১৯ সালে প্রায় ৫০ হাজারের মতো পেজ ছিল উদ্যোক্তাদের। করোনাকালে সে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে চার লাখ।তবে দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলোর ব্যবসায়ীদের দাবি, অফলাইন বা শো-রুমভিত্তিক যে পরিমাণ ব্যবসা হয় এখনো অনলাইনে তা হচ্ছে না। অনলাইনে বাজার এখনো বেড়ে ওঠেনি। বিশেষ করে, যারা অফলাইনে ব্যবসা করি। দেশীয় পণ্যকে যারা একটি মাত্রা যোগ করে মানুষের কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছি, তাদের ক্ষেত্রে অনলাইন সে অর্থে এগিয়ে যায়নি। কারণ মানুষ আসলে দেখে ও যাচাই করে পণ্য কিনতে অভ্যস্ত। তাছাড়া অনলাইন ব্যবসায়ীরা এখনো মানুষের আস্থার জায়গায় পৌঁছাতে পারেনি। তাই লকডাউনের কারণে যে ক্ষতি হয়েছে তা অনলাইন ব্যবসার মাধ্যমে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না।