শেরপুরঃ শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার শালমারা গ্রামে অবস্থিত সুতানাল নামের এক দীঘি। কারো মতে কমলা রাণী বা সুতানাল, আবার কারো কাছে রাণী বিহরণী নামে দীঘিটি পরিচিত। তবে প্রাচীন কালের এই দীঘিটি এলাকায় সুতানাল দীঘি নামে পরিচিতি লাভ করেছে। এই দীঘির নামকরণে রয়েছে চমকপ্রদ প্রাচীন কাহিনী। ৬০ একর জমির উপর নির্মিত এ দীঘিটি। এটি এলাকার প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শন বলে প্রবীনরা জানান। দীঘিটি দেখার জন্য বছরের প্রায় প্রতিদিন উৎসুক মানুষ ছুটে আসেন দুর-দুরান্ত থেকে। উপজেলা সদর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে উত্তরে ভারত সীমান্তবর্তী কাকরকান্দি ইউনিয়নের শালমারা গ্রামে অবস্থিত এ সুতানাল দীঘি।ঐতিহাসিক এ দীঘিটি কে কখন কোন উদ্দেশ্যে খনন করেছিলেন তার সঠিক কোন তথ্য পাওয়া যায়নি আজো। তবে অনেকেই বলেন, মোঘল আমলের শেষের দিকে এ গ্রামে কোনো এক সামন্ত রাজার বাড়ি ছিল। আবার কেউ বলেন, এখানে একটি বৌদ্ধ-বিহার ছিল। কথিত আছে, রাণী বিহরণী সামন্ত রাজাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, তুমি কী আমাকে ভালবাসার নিদর্শন হিসেবে কিছু দিতে চাও? তাহলে এমন কিছু দান কর যা যুগযুগ ধরে মানুষ আমাকে মনে রাখবে। তখন রাজবংশী সামন্ত রাজা রাণীকে খুশি করার জন্য সিদ্ধান্ত নিলেন। চরকীর সাহায্যে অবিরাম একদিন একরাত সুতা কাটা হবে। দৈর্ঘ্যে যে পরিমান সুতা হবে। সেই পরিমান সুতার সমান লম্বা এবং প্রশস্ত একটি দীঘি খনন করা হবে। ওই দীঘির জল জনগণ ব্যবহার করবে আর তোমাকে স্বরণ রাখবে। রাণীর সম্মতিতে পরিকল্পনা অনুযায়ী দীঘির খনন কাজ শুরু হলো। দিনের পর দিন খনন কাজ চলতে থাকে। নির্মিত হয় বিশাল এক দীঘি। এই দীঘির এক পাড়ে থেকে অন্য পাড়ের মানুষ চেনা যায় না। আরো কথিত আছে, খননের পর দীঘিতে জল উঠেনি। জল না উঠায় নিচের দিকে যতটুকু খনন করা সম্ভব ততটুকু খনন করা হয়। তবু জল না উঠায় রাজা প্রজা সবাই চিন্তিত হয়ে পড়েন। অবশেষে কমলা রাণী স্বপ্নাদেশ পান গঙ্গাপূজা কর নর বলি দিয়া, তবেই উঠিবে দীঘি জলেতে ভরিয়া। স্বপ্ন দেখে রাণী চিন্তিত হয়ে পড়েন। নরবলি দিতে তিনি রাজী হলেন না। নর বলি না দিয়ে রাণী গঙ্গামাকে প্রণতি জানান। মহাধুমধামে বাদ্য-বাজনা বাজিয়ে দীঘির মধ্যে গঙ্গা পুজার বিরাট আয়োজন করা হয়।কমলা রাণী গঙ্গামায়ের পায়ে প্রার্থনা জানিয়ে বলেন, কোন মায়ের বুক করিয়া খালি! তোমাকে দিব মাতা নরবলি? আমি যে সন্তানের মা আমায় করিয়া রক্ষা কোলে তুলিয়া নাও। মা পূর্ণ কর তোমার পুজা অর্চনা। তখন হঠাৎ বজ্রপাতের মতো শব্দে দীঘির তলায় মাটির ফাটল দিয়ে জল উঠতে লাগল। লোকজন দৌড়ে দীঘির পাড়ে উঠলো। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে দীঘির টইটুম্বর জলে রাণী বিহরণী তলিয়ে গেলেন দীঘির জলে। কমলা রাণীর আর তীরে উঠে আসা সম্ভব হয়নি। রাজার কাছ থেকে চিরতরে হারিয়ে গেলেন তিনি। সেই থেকে কমলা রাণী বা সুতানাল নামেই এ দীঘি পরিচিতি পায়।
শেরপুর-২ (নকলা-নালিতাবাড়ী) আসনের সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত অধ্যাপক আব্দুস সালাম রচিত নালিতাবাড়ী মাটি মানুষ এবং আমি নামের এক বই থেকে জানা যায়, খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে শালমারা গ্রামে সশাল নামের এক গারো রাজা রাজত্ব করতেন। শালমারা গ্রামের উত্তরে গারো পাহাড় পর্যন্ত তার অধীনে ছিল। শামস উদ্দিন ইলিয়াস শাহ তখন বাংলার শাসনকর্তা ছিলেন। ১৩৫১ সালে তিনি সশাল রাজার বিরুদ্ধে সেনা প্রেরণ করেন। সশাল রাজার রাজধানী ছিল শালমারা গ্রামে। রাজা পলায়ন করে আশ্রয় নেন জঙ্গলে। পরবর্তীকালে গারো রাজত্ব প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর রাজা সশাল শত্রুর আক্রমন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দীঘির মাঝখানে ছোট একটি ঘর তৈরি করে চারদিকে পরিখার মতো (খাল) খনন করেন।
রাজা যখন সেখানে অবস্থান করতেন তখন তার বাহিনী বড় বড় ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে চারদিক পাহারা দিতেন। কালক্রমে এই ভূখন্ডটি দীঘিতে রুপ নেয়। রাজার শেষ বংশধর ছিলেন রাণী বিহরনী। দীঘিটি রাণী বিহরণী নামে পরিচিতি পায়।১৯৪০ সালে সরকারী ভূমি জরিপে দীঘিটিকে রাণী বিহরনী নামেই রেকর্ড করা হয়েছে। তবে দীঘিটি খননের সত্যিকারের দিনক্ষন ইতিহাসে জানা না গেলেও এটা যে একটা ঐতিহাসিক নিদর্শন এ বিষয়ে এলাকার কারও কোন সন্দেহ নেই।অনেক বছর দীঘিটি পরিত্যক্ত থাকায় জলের উপর শৈবাল জমে গজিয়ে উঠে ঘাস। ১৯৭২ সালে প্রথম দীঘিটি সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহন করা হয়। ১৯৮৩ সালে দীঘিটি কেন্দ্র করে গড়ে উঠে সুতানাল দীঘিপাড় ভুমিহীন মজাপুকুর সমবায় সমিতি। ১৯৮৪ সালে সমিতিটি রেজিষ্ট্রেশন প্রাপ্ত হয়।সমিতির সদস্যরা দীঘির পাড়ে ঘর-বাড়ি নির্মাণ করে বসবাস শুরু করেন। দীঘিটিকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর অক্টোবর মাসে এখানে সৌখিন মৎস্য শিকারীদের মিলন মেলায় পরিণত হয়। সারাদেশ থেকে আসা মৎস্য শিকারীরা সমিতির দেয়া টিকেটের মাধ্যমে মাছ শিকার করেন। এ দীঘির মাছ খুব সুস্বাদু বলে বেশ সুনাম আছে।ঐতিহাসিক এ দীঘিকে কেন্দ্র করে ভুমিহীনদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মৎস্য শিকারী ও উৎসুক জনতার যাতায়াতে পরিবেশ হয়ে উঠে উৎসবমুখর। কালের সাক্ষী হিসেবে আজও রয়েছে এই সুতানাল দীঘি।