মো. আল আমিন, জেলা প্রতিনিধি: সম্প্রতি একটি ভীতিকর পরিস্থিতি ও অনাকাঙ্খিত ঘটনার নিরব সাক্ষী কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলার গোবরিয়া আব্দুল্লাহপুর ইউনিয়নের দশকাহনিয়া ও শ্বশানীপাড়ার মানুষজন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, টিনের ঘরের বেড়া, দরজা, পাকা ঘরের জানালা, গ্রিল, ঘরে থাকা ফ্রিজ, টিভি, খাট, আলমিরা, সুকেজ, বেসিন, পড়ার টেবিল, রান্না বান্নার তৈজসপত্রসহ ছয় থেকে সাতটি ঘরে থাকা প্রতিটি জিনিসপত্রই কুপিয়ে তছনছ করে ফেলা হয়েছে। আতঙ্কের ছাপ ভুক্তভোগী প্রতিটি পরিবারের সদস্যের চোখে মুখে। কেউ মুখ খুলছে না, ভয় যেনো তাদের তাড়া করছে।
গত ৮ নভেম্বর রাত নয়টা থেকে সাড়ে নয়টার দিকে এ ঘটনা ঘটেছে বলে জানান ভুক্তভোগীরা। প্রায় তিনশো থেকে সাড়ে তিনশো মানুষজনের একটি দল এ ঘটনা ঘটিয়েছে বলে জানান ভুক্তভোগীরা।
তবে কি এমন কারন রয়েছে এর পিছনে? কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে? এ ঘটনার মূলত দায়ী কে বা কারা ? প্রত্যেকটি ভাঙচুরের দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করে স্থানীয়দের সাথে কথা বলতে চাইলে কেউ মুখ খুলছে না।
পরে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশকয়েকজন ব্যক্তি বলেন, এটি রাজনৈতিক সহিংসতা! মূলত যাদের ঘর বাড়ি ভাঙা হয়েছে অধিকাংশই ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামীলীগের সমর্থক বা কারো পদ পদবী ছিলো একসময়।
এলাকায় অভিযোগ রয়েছে, অনেকেই বিগত সরকারের সময় দলীয় প্রভাবে খাসজমি দখল, অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, মাদকের শেল্টার ও প্রভাব খাটিয়ে নিরীহ মানুষদের উপর অন্যায় অবিচার করেছে।
তবে এ এলাকায় বিগত সময় রাজনৈতিক সংঘাত কখনোই প্রকাশ্যে এভাবে আসেনি। পরিবেশ ছিলো শান্ত। কিন্তু কেনো শান্তিপূর্ণ এ গ্রামটিতে রাজনৈতিক সহিংসতা হয়েছে! এমন প্রশ্ন সাধারণ মানুষের।
জানা গেলো, ইউনিয়ন ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক পলাশ (২৫) ও স্থানীয় মসজিদের ইমাম মোহাম্মদ আলী ওরফে রুকন (২৪) আহত হয়েছেন।
শ্বশানীপাড়ার হারিস মিয়ার ছেলে পলাশ। দশকাহনিয়া গ্রামের আবু সালেকের পুত্র মোহাম্মদ আলী।
পলাশের রাজনৈতিক পরিচয় থাকলেও মোহাম্মদ আলীর রাজনৈতিক পরিচয় নেই। তবে তার বাবা আবু সালেক ২০১৪ সাল পর্যন্ত ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সভাপতি পদে ছিলেন। এখন তিনি রাজনীতির সাথে আর সম্পৃক্ত নন পেশায় সার্ভেয়ার(আমিন) বলে জানা যায়।
এ ঘটনায় আবু সালেক বাদী হয়ে ছাত্রদল নেতা পলাশকে আসামী করে ডাকাতির অভিযোগে আদালতে একটি অভিযোগ দায়ের করেছেন। বিষয়টি তিনি নিজেই নিশ্চিত করেছেন এ প্রতিবেদককে।
পলাশের বাবাও বাদী হয়ে প্রায় ১৭ জনের নামে থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন।
আবু সালেককে প্রধান আসামী করে তার আপন বড় ভাই, ছেলে, ভাতিজা ও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আবু বাক্কারসহ ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকার আওয়ামী সমর্থকদের আসামী করা হয়েছে এ মামলায়।
পলাশের বাবার ভাষ্য, আবু সালেক ও তার ভাই আঃ রউফ ঘটনার দিন বিকেলে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা শরীফুল আলমকে নাথের বাজারে গালিগালাজ করে। এ বিষয়ে প্রতিবাদ করে পলাশ। তখন তাকে হত্যার হুমকি দেয় তারা। পরে রাতে রাস্তা দিয়ে মোটরসাইকেলযোগে যাওয়ার সময় পূর্বপরিকল্পিতভাবে হত্যার উদ্দেশ্যে আবু সালেকের বাড়ির সামনের রাস্তায় দলবলসহ তাকে আক্রমন করে আহত করা হয়।
এ নিয়ে ওইদিনই নাথের বাজারে মিছিলসহ প্রতিবাদ করে স্থানীয় বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
তবে এ বিষয়ে আবু সালেকের সাথে মুঠোফোনে কথা বললে তিনি বলেন, রাতে পলাশের নেতৃ্ত্বে একদল লোক তার বাড়িতে ডাকাতি করতে যায়। তার ঘরের স্বর্ণালঙ্কার, টিভি ও নগদ টাকা দেশীয় অস্ত্রের মুখে নিয়ে যায় তারা। এসময় তাকে গলায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে আটকে রাখে। মসজিদের ইমাম ছেলে এগিয়ে গেলে তাকে মাথায় আঘাত করে আহত করা হয়। পরে তার ঘরবাড়ি ও জিনিসপত্র কুপিয়ে তছনছ করা হয়।
পলাশ কিভাবে আঘাত পেলো এ বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি দাবি করেন,আমাকে তারা
আটকে রাখার এক পর্যায়ে ধ্বস্তাধস্তি হয়। এসময় সে আঘাত পেতে পারে। পরে দ্রুত আমি পালিয়ে প্রাণ বাঁচাই।
তবে বিএনপি নেতাদের দাবি, পলাশের হাতে পায়ে ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ও মারধর করে জখম করা হয়েছে।
আবু সালেকের দাবি তিনি তাকে কোনো রকম মারধর করেননি। তার নেতৃত্বে লোকজন তার বাড়িতে ডাকাতি করতে আসলে প্রতিহত করতে গিয়ে সে আঘাত পেয়ে থাকতে পারে। আপনারা তার শারীরিক আঘাতগুলো চেক করলেই বুঝতে পারবেন সত্য বলছে নাকি মিথ্যা বলছে।
শরীফুল আলমকে গালিগালাজের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি শরীফুল আলম সাহেবকে শ্রদ্ধা করি। কেনো তাকে গালিগালাজ করবো? আমি ২০১৪ সালের পর থেকে রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত নই। আমার ছেলেকে মাদরাসায় পড়িয়েছি। সে একজন ইমাম ও কওমী মাদরাসার শিক্ষক। এ সুবাদে আমি রাজনীতি করি না। সরকার পতনের পর থেকে আমি বাজারেও তেমন যাইনা কারন যেহেতু এক সময় আওয়ামী রাজনীতি করেছি।
তার বড় ভাই আঃ রউফের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার বড় ভাই অসুস্থ। ব্রেইন স্ট্রোকের রোগী। আমার পরিবারের কেউ রাজনীতির সাথে জড়িত না।
এ বিষয়ে উপজেলার বিএনপি নেতা শাহজাহান চেয়ারম্যান বলেন, গোবরিয়া আব্দুল্লাহপুর ইউনিয়নে কখনো রাজনৈতিক সংঘাত ছিলো না। পলাশের উপর হামলা ও ঘরবাড়ি ভাঙচুরের তীব্র নিন্দা জানাই। দ্রুত এ ঘটনার আইনী প্রতিকার চাই।
শ্বশানীপাড়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা মৃত রসমত আলীর ছেলে পলাশের মামলায় অভিযুক্ত আবু কালাম বলেন, আমরা আওয়ামী রাজনীতির সমর্থক। তবে কখনো সংঘাতে ছিলাম না। আমার ঘর বাড়ি কেনো ভাঙা হলো জানি না। এ এলাকায় প্রায় ৬ থেকে ৭ জন আওয়ামী সমর্থকদের ঘর বাড়ি ভাঙা হয়েছে।
ডা. মুজিবুর রহমানের ঘর বাড়ি ভাঙার বিষয়ে বলেন, রাতে আমি ও আমার স্ত্রী শুয়ে ছিলাম। হঠাৎ কিছু লোক আমার গ্রিল ভেঙে ভিতরে ডুকে আমার ছেলেকে খুঁজতে থাকে। না পেয়ে আমার ঘরের তিন থেকে চারটি রুম ও ভিতরের জিনিসপত্র ভেঙে চুরমার করে ফেলা হয়। আমার ছেলে রাজনীতি করতো।
বিএনপি সমর্থকদের স্পষ্ট বক্তব্য, আমরা পলাশের উপর হামলার বিচার চাই। তাদের আরো দাবি শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেও প্রেতাত্মারা এখনো রয়ে গেছে। তাদের শক্ত হাতে দমন করার কথাও বলেন তারা।
এ বিষয়ে জানতে চেয়ে কুলিয়ারচর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফাকে মুঠোফোনে কল দিলে তিনি বলেন, ছাত্রদলের ছেলেটি আহত হয়ে হাসপাতালে আছে। তার মামলা রেকর্ড হয়েছে।
যাদের ঘরবাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে তাদের পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ করা হয়েছে কি না তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাদেরকে অভিযোগ দিতে বলা হয়েছিলো। তারা অভিযোগ দেয়নি।
আদালতের মাধ্যমে অভিযোগ দিয়েছে তারা বিষয়টি বললে তিনি বলেন তদন্ত আসুক তারপর বলা যাবে।