কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে রাজস্ব শাখায় ১৫ জন অফিস সহায়ক ও একজন নিরাপত্তা প্রহরীর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর। এতে প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণি এবং বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে হতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়। প্রার্থীকে কুষ্টিয়া জেলার স্থায়ী বাসিন্দা হতে হবে বলেও শর্ত দেওয়া হয়। তবে এসব শর্তের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ত্রিশোর্ধ্ব ব্যক্তিকে যেমন নিয়োগের ঘটনা ঘটে, তেমনই অন্য জেলার বাসিন্দাকেও নিয়োগ দেওয়া হয়। বয়স কমাতে এনআইডি জালিয়াতির ভয়ংকর ঘটনাও ঘটে। অনিয়মের মাধ্যমে এ নিয়োগে জেলা প্রশাসক মো. আসলাম হোসেন কোটি টাকার বাণিজ্য করেন বলে অভিযোগ আছে। শুধু নিয়োগ বাণিজ্যই নয়; হাট-বাজার ইজারা, বালুমহাল থেকে মাসোহারা আদায়, মেলার নামে জুয়া খেলার অনুমতি দিয়ে ঘুষগ্রহণ, সরকারি চাল ক্রয়ে কমিশন আদায়সহ অসংখ্য অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে। অবৈধভাবে সম্পদের পাহাড় গড়া ডিসি আসলাম সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরায় স্ত্রীর নামে দুটি ফ্ল্যাট কিনেছেন; কোটি টাকার এফডিআর করেছেন স্ত্রী ও এক আত্মীয়র নামে। কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত মানিকগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ছিলেন আসলাম হোসেন। এরপর তাঁকে বদলি করা হয় গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সচিব হিসেবে। সেখান থেকে তাঁকে বান্দরবানে বদলি করা হয় জেলা প্রশাসক হিসেবে। সেখানে পাঁচ মাস দায়িত্ব পালন শেষে ২০১৮ সালের ৯ আগস্ট কুষ্টিয়ায় ডিসি হিসেবে যোগদান করেন আসলাম। এর আগে ২০১১-১২ সালে তিনি কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে ছিলেন।
কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে জানা গেছে, কুষ্টিয়ায় ডিসি হিসেবে যোগদানের সাড়ে আট মাসের মাথায় ২০১৯ সালের ২৫ ও ২৮ এপ্রিল আসলাম হোসেন ঘুষের টাকায় রাজধানীর উত্তরায় (১৪ নম্বর সেক্টরের ১৭ নম্বর সড়কের ৫৮ নম্বর প্লট) ‘টিডিএল ফেরদৌস’ ভবনের দুটি ফ্ল্যাট কেনেন। নিবন্ধনের সময় তিনি ক্রেতা হিসেবে স্ত্রী মোসা. জাকিয়া সুলতানাকে দেখিয়েছেন। প্রায় দুই কোটি টাকায় বিলাসবহুল ফ্ল্যাট দুটি কেনা হলেও দাম দেখানো হয়েছে মাত্র ৩২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ফ্ল্যাট কেনার এই দলিল কালের কণ্ঠ’র হাতে আছে। কুষ্টিয়ায় যোগদানের আগে তিনি রাজধানীর আদাবরে স্ত্রীর নামে আরো একটি ফ্ল্যাট কিনেন। বর্তমানে এসব ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়ে রাখা হয়েছে।
জানতে চাইলে দুর্নীতিবিরোধী সংগঠন টিআইবি পরিচালিত সচেতন নাগরিক কমিটি কুষ্টিয়ার সভাপতি জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার রফিকুল আলম টুকু বলেন, ‘জেলা প্রশাসক মো. আসলাম হোসেন বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি করেছেন—এমন আলোচনা বিভিন্ন মহলে আছে। পত্রপত্রিকায় লেখালেখিও হয়েছে। আমি মনে করি, এই পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা এত অনিয়ম করে থাকলে সরকারের উচিত তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা।’
২০১৯ সালের বিজ্ঞাপিত ১৬ পদে নিয়োগ দেওয়া হয় গত ২৪ আগস্ট। এ নিয়োগে জেলা প্রশাসক নিয়োগবিধি লঙ্ঘন করে নিজ বাসার বাবুর্চি ও নিরাপত্তা প্রহরীর দুই বোন এবং অন্য জেলার এক বাসিন্দাসহ মধ্যবয়সী ১৬ জনকে নিয়োগ প্রদান করেন। এ নিয়ে গত ৬ অক্টোবর কালের কণ্ঠ’র শেষ পৃষ্ঠায় ‘কুষ্টিয়া ডিসি অফিসে নিয়োগ পদায়নে ব্যাপক অনিয়ম’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তবে অনিয়ম নিয়ে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে ১৬ নভেম্বর নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের পদায়ন করা হয়। পরে ২৮ নভেম্বর কালের কণ্ঠে ‘এনআইডি জালিয়াতি করে বয়স কমিয়ে চাকরি’ শিরোনামে আরেকটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। অনিয়মের অভিযোগ তদন্তে পরদিন তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেন খোদ জেলা প্রশাসক। কমিটিকে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হলেও দুই মাসেও প্রতিবেদন জমা হয়নি।
এ বিষয়ে তদন্ত কমিটির দুই সদস্য জেলা সিভিল সার্জনের প্রতিনিধি ডাক্তার রাকিবুল ইসলাম এবং জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার জায়েদুর রহমান মুখ খুলতে রাজি হননি। তবে কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. সিরাজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা তদন্ত কাজ শুরু করেছি, বেশ কিছু অনিয়ম পেয়েছি। তদন্ত অনেকদূর এগিয়েছে। কিন্তু নানা সীমাবদ্ধতার কারণে এখনো রিপোর্ট দিতে পারিনি।’
জেলা প্রশাসনের একাধিক সূত্র জানায়, এর আগে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জেলা প্রশাসনের সাধারণ শাখায় আরো ১৬ কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়। তখন বিনা বেতনে ওমেদার হিসেবে কাজ করা আটজনের চাকরি স্থায়ী করতে দুই লাখ টাকা করে ১৬ লাখ টাকা, চারজন কোটাধারীর কাছ থেকে চার লাখ করে ১৬ লাখ এবং চারজন সাধারণ চাকরি প্রার্থীর কাছ থেকে আট লাখ করে ৩২ লাখসহ মোট ৬৪ লাখ টাকা ডিসি আসলাম ঘুষ নেন বলে অভিযোগ আছে। প্রায় একই সময়ে ছয় ইউপি সচিব নিয়োগের ক্ষেত্রে পাঁচ জনের কাছ থেকে জনপ্রতি ২০ লাখ করে এক কোটি টাকা নেন। করোনার কারণে গত ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস পালনে শিথিলতা থাকলেও তা উদযাপনের নামে ডিসির লোকজন সরকারি-বেসকারি প্রতিষ্ঠান ও দোকানদারদের কাছ থেকে দুই হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা এবং শতাধিক ইটভাটা মালিকদের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা করে চাঁদা আদায় করেন। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ভর্তি পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ করা ১৮ জন ছাত্রছাত্রীকে ২০২০ সালের ৩০ ডিসেম্বর টাকার বিনিময়ে জেলা স্কুল ও গার্লস স্কুলে ভর্তির সুযোগদানের অভিযোগও আছে। সর্বশেষ গত ৩ জানুয়ারি ইউনিয়ন পরিষদে ২১ জন হিসাব সহকারী নিয়োগ দিয়ে জনপ্রতি ১৫ লাখ টাকা করে তিন কোটি টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে আসলামের বিরুদ্ধে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিসি অফিসের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী জানান, কুষ্টিয়ায় যোগদানের পরপরই আসলাম হোসেন মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে জেলার আইলচারা, বালিয়াপাড়া ও উজানগ্রাম হাট একটি প্রভাবশালী মহলের কাছে ইজারা পাইয়ে দেন। এরপর তিনি জেলার ইটভাটা মালিকদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে কাঠ পোড়ানোর বন্দোবস্ত করে দেন। তারপর অভিযান শুরু হয় অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে। অবৈধ সব বালুমহাল বন্ধ করা হলেও চালু রাখা হয় শুধু জিলাপিতলা বালুমহাল। সেখানে ডিসি আসলাম তাঁর অফিসের ওমেদার আনিস ও শরিফুলকে দিয়ে বালু উত্তোলন করেন। সেই বালু নির্মাণাধীন কুষ্টিয়া-রাজবাড়ী সড়কের ঠিকাদারের কাছে বিক্রি করে পাঁচ মাসে ৪৫ লাখ টাকা করে সোয়া দুই কোটি টাকা অবৈধভাবে উপার্জন করেন আসলাম। ২০১৯ সালের শীতে কুমারখালীতে মেলার নামে জুয়া খেলার অনুমতি দিয়ে ২০ লাখ টাকা ঘুষ নেন তিনি। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে আমন মৌসুমে এবং ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে বোরো মৌসুমে ৫০ হাজার টন চাল কেনার সময় মিলমালিকদের কাছ থেকে দেড় কোটি টাকা কমিশন নেওয়ার অভিযোগও আছে। এক খাদ্য কর্মকর্তা তিন কিস্তিতে এই টাকা ডিসির বাংলোতে দিয়ে আসেন। সরকারি চাল সংগ্রহ কমিটির সভাপতি হিসেবে ডিসি ২০১৯-২০ সংগ্রহ মৌসুমে দুটি মিলকে ৪৭৫ টন করে দুইবার বরাদ্দ দিয়ে এক কোটি টাকা নেন। পরে তা ভাগ-বাটোয়ারা করা হয়। জেলা প্রশাসক গত বছর তাঁর নিজের অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বার্ষিক ৬০ ঘণ্টা কর্মশালার জন্য বরাদ্দকৃত ২৬ লাখ টাকার মধ্যে সম্মানীর ১২ লাখ ৩০ হাজার টাকা পরিষোধ করেন। তবে অংশগ্রহণকারীদের আপ্যায়ন ও উপকরণসহ অন্য খাতের ১২ লাখ ৭০ হাজার টাকা না দিয়ে তিনি আত্মসাৎ করেন।অফিসের কর্মচারীরা জানান, কর্মশালায় আপ্যায়ন ও উপকরণ কেন দেওয়া হলো না, সে বিষয়ে প্রশ্ন করায় ডিসি আসলাম তাঁদের কয়েকজনকে বদলি করে দেন। ডিসি অফিসের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সময় জেলা নাজিরের মাধ্যমে বাজারের ৩৫ জন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে মাছ, মাংস, ফল, মুরগিসহ বিভিন্ন পণ্য কেনা বাবদ ৬২ লাখ টাকার বিল এক বছরেও পরিশোধ করা হয়নি।সাবেক জেলা নাজির আব্দুল মতলেব বলেন, ‘এক বছরের বেশি সময় ধরে ডিসি অফিস ও বাংলোর বিভিন্ন প্রয়োজনে দোকানিদের কাছ থেকে অর্ধ কোটিরও বেশি টাকার বাজার করা হয়েছে। কিন্তু ডিসি স্যার বিল দিচ্ছিলেন না। একপর্যায়ে দোকানিদের চাপে আমি স্যারকে বিল পরিশোধের জন্য জোরাজুরি করলে আমাকেসহ ২২ জনকে একসঙ্গে বদলি করে দেন। পরে আমি ধারদেনা করে ও লোন নিয়ে কয়েক লাখ টাকা পরিশোধ করি। সেই টাকাও তিনি আমাকে দেননি।’কুমারখালী বেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী বাবুল আক্তার বলেন, “বিল পরিশোধে অনেক জোরাজুরির পর জেলা প্রশাসক আমাকেসহ কয়েকজন দোকানিকে ডেকে নেন। এরপর পাওনার অর্ধেক টাকা পরিশোধ করে ‘পরিশোধিত’ বলে লিখে নেওয়া হয়।”
জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষ নেতা বলেন, ‘আমরা সরকারে আছি, তাই একজন সরকারি কর্মকর্তার দুর্নীতি নিয়ে আমাদের সরাসরি বলা ঠিক হবে না। তবে কুষ্টিয়ার বর্তমান জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের বিষয় আমাদের কানে বিভিন্ন সময় এসেছে। আমরা মনে করি, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা আছে, যাদের এগুলো দেখা উচিত।’
সার্বিক বিষয়ে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মো. আসলাম হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথমে এসব বিষয়ে কথা বলতে চাননি। পরে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘সব মিথ্যা কথা। যা কিছু করেছি, সব নিয়মের মধ্যেই হয়েছে। আমি নিয়মের বাইরে কিছুই করিনি।’ এরপর তিনি সাবেক জেলা নাজিরসহ দুজন সরকারি কর্মকর্তা ও একজন কর্মকর্তার ভাইকে দিয়ে সংবাদ প্রকাশ না করার জন্য এ প্রতিবেদককে অনুরোধ করেন।