দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার দাবিতে কর্মসূচি পালনে কৌশলে এগোচ্ছে বিএনপি। এ ইস্যুতে সারা দেশে ‘জনমত’ গঠনই দলটির এখন প্রধান লক্ষ্য। এজন্য মানববন্ধন, দোয়া, স্মারকলিপি ও বিক্ষোভ-সমাবেশের মতো ছোট কর্মসূচি দিয়ে মাঠে থাকতে চায়। এরপর কঠোর আন্দোলনের পরিকল্পনা দলটির। তবে এ মুহূর্তে দলীয় নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ রেখে কর্মসূচি বাস্তবায়নের ওপর জোর দিচ্ছেন নীতিনির্ধারকরা। একই সঙ্গে কোনো কিছুতে বিভ্রান্ত বা কারও ফাঁদে পা না দিতে তৃণমূল নেতাকর্মীদের কেন্দ্র থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দলীয় সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
সূত্র আরও জানায়, খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের বিষয়টিতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। তাই সমঝোতার পথও খোলা রাখতে চাইছেন। যে কারণে এখনই বড় ধরনের কোনো কর্মসূচির বিপক্ষে নেতারা। খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে সুচিকিৎসার দাবিতে চলমান ৮ দিনের কর্মসূচির প্রধান লক্ষ্য জনমত গঠন করা। যেখানে বিএনপির পক্ষ থেকে এককভাবে কর্মসূচি দেওয়া হয়নি। ছাত্রদল, যুবদল, শ্রমিকদল, মহিলা দল, জাসাসসহ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনও পৃথকভাবে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে কর্মসূচিতে সারা দেশের তরুণ, যুবক, নারী, শ্রমিকসহ সব শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। পাশাপাশি বিএনপিপন্থি আইনজীবী ও পেশাজীবী সংগঠনও একই দাবিতে কর্মসূচি পালন করছে। শুক্রবার বিএনপির উদ্যোগে মসজিদে মসজিদে দোয়া ও মোনাজাত এবং মন্দির, গির্জা, প্যাগোডাসহ ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়ে প্রার্থনা কর্মসূচি পালন করা হয়। সামনে রয়েছে ঢাকাসহ দেশব্যাপী বিভাগীয় সদরে সমাবেশ। দলটির নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, এসব কর্মসূচির মাধ্যমে দলীয় চেয়ারপারসনের চিকিৎসা নিয়ে সরকারের মনোভাব সম্পর্কে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে পৌঁছানো যাবে। বিদেশেও দলীয় নেতাকর্মীরা বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবেন। এ নিয়ে ব্যাপক জনমত তৈরি হবে।
জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দেশনেত্রী খালেদা জিয়া। আমরা বারবার বলেছি, দেশের জনগণও এখন বিশ্বাস করেন- সরকারের ইচ্ছে নেই তিনি বেঁচে থাকুক। সে কারণে এখন পর্যন্ত তার বাইরে (বিদেশ) যাওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। অথচ আজ দেশের ডান-বাম সব রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ দাবি তুলেছেন খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করার। সমাজে দেশনেত্রীর চিকিৎসা ইস্যুতে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। আন্দোলন ছাড়া কোনো পথ খোলা নেই। আমাদের পক্ষ থেকে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছি।
বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা জানান, খালেদা জিয়াকে মেডিকেল বোর্ড দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার কথা বলেছেন। অথচ সরকার অনুমতি দিচ্ছে না। চিকিৎসা একজন মানুষের মৌলিক অধিকার। সে অধিকার থেকে সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রীকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এ নিয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। তারা এখনই কঠোর কর্মসূচি পালনের জন্য চাপ দিচ্ছেন। যা বিভিন্ন সাংগঠনিক জেলার নেতারা দলের নীতিনির্ধারকদেরও জানিয়েছেন। এ বিষয়ে কেন্দ্র থেকে তাদের ধৈর্য ধরার অনুরোধ জানানো হয়েছে। শুক্রবার এক সমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, খালেদা জিয়াকে বিদেশ পাঠানোর আন্দোলনে নেতাকর্মীদের সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিতে হবে। আপনারা শক্ত কর্মসূচির কথা বলেন। শক্ত কর্মসূচি বলতে কোনো কর্মসূচি নেই। রাজপথে এটা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে এটি শক্ত করবেন না কি নরম করবেন, সেটা আপনাদের ওপর নির্ভর করবে। আর রাজনীতির ভাষায় কঠোর কর্মসূচি বলতে কোনো ডেফিনেশন নেই। দিনক্ষণ দেখে কখনো কোনো বিস্ফোরণ ঘটে না। জনগণের আন্দোলন রিমোট কন্ট্রোলে চলে না। জনগণের বিস্ফোরণের রিমোট কারও হাতে থাকে না। সেই কারণে বলছি, প্রস্তুত থাকুন, আর আমরাও প্রস্তুত থাকব।
১৩ নভেম্বর থেকে এভারকেয়ার হাসপাতালের সিসিইউতে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়া। বিএনপি নেতারা জানান, দেশি-বিদেশি চিকিৎসকরা বলেছেন, বাংলাদেশে তার চিকিৎসা আর সম্ভব নয়। সম্প্রতি খালেদা জিয়ার পরিবারের পক্ষ থেকে তাকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার অনুমতি দিতে সরকারের কাছে আবেদন জানানো হয়। শনিবার এ ব্যাপারে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য তারা বিদেশ থেকে চিকিৎসক আনতে পারবেন। যত বড় চিকিৎসক তারা আনতে চান, আনতে পারেন। সেটায় সরকার কোনো বাধা দেবে না। কিন্তু এটাও তাদের মনে রাখতে হবে, দেশের আইনে যা আছে, তার বাইরে গিয়ে সরকার কোনো কিছু করবে না।
খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে সুচিকিৎসার দাবিতে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত টানা কর্মসূচি রয়েছে বিএনপির। এসব কর্মসূচির পর আবারও নতুন কর্মসূচি দেওয়া হবে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। বিএনপি নেতারা জানান, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দল ছাড়া দেশের অধিকাংশ দল খালেদা জিয়াকে বিদেশে সুচিকিৎসার আহ্বান জানিয়েছে। চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এ নিয়ে দেশের জনগণ ক্ষুব্ধ। বিদেশে চিকিৎসার দাবিতে শনিবার নয়াপল্টনে গণ অনশন কর্মসূচিতে জেএসডি, নাগরিক ঐক্য, গণফোরামসহ ২০ দল ও বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নেতারাও অংশ নেন। এছাড়া ২০ দল ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সব শরিক দল, বাসদ, গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশ ন্যাপ, এবি পার্টি, এনডিপি, নাগরিক অধিকারও বিবৃতি দিয়েছে। শনিবার ২০ দলীয় জোটের পাঁচটি দল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে স্মরকলিপি দেয়। হাসপাতালে গিয়ে খোঁজ নিয়েছেন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর পরিবার, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, গণঅধিকার পরিষদের আহ্বায়ক ড. রেজা কিবরিয়া ও সদস্য সচিব ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরসহ অনেকে। সবার দাবি, খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো হোক।
বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম আজাদ বলেন, খালেদা জিয়া নেতাকর্মীদের কাছে আবেগের জায়গা। দেশনেত্রীকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর দাবি সরকার না মানলে আন্দোলন তীব্র থেকে আরও তীব্রতর করা হবে। এ আন্দোলনের মাধ্যমেই সরকারের পতন হবে।