বিশেষ প্রতিনিধি গাইবান্ধা :
মাকছুদা বেগমের (৩৫) স্বামী আলমগীর হোসেন ভ্যানচালক। তিন মেয়ে, পাঁচ সদস্যের সংসার। ছোট্ট ভিটেমাটি ছাড়া চাষের জমিও নেই তাঁদের। একসময় দিন এনে দিন চলত মাকছুদার পরিবারের। তিন মেয়েকে পড়াশোনা শিখিয়ে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্নটাও দুঃস্বপ্ন মনে হয়েছিল তখন। তবে গরু পালনের এক উদ্যোগে শামিল হয়ে এখন সুদিনের স্বপ্ন দেখেন মাকছুদা।
মাকছুদা বেগমের বাড়ি গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপজেলার ছত্রগাছা গ্রামে। গ্রামটি উপজেলার ধাপেরহাট ইউনিয়নের। এখানে মাকছুদার মতো ৭৫ জন নারী গরু লালনপালন করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। তাঁদের এই সুযোগ করে দিয়েছে সর্বজয়া প্রকল্প। ঢাকার ওয়াটার মার্ক লাইভস্টক ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ এটি।
২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকল্পের আওতায় মাকছুদাকে চারটি গরু কিনে দেওয়া হয়। তিনি সেগুলো লালনপালন করতে থাকেন। গরু রাখার জন্য ছাউনিও নির্মাণ করে দেয় প্রতিষ্ঠানটি, দেওয়া হয় মোটাতাজাকরণের প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনীয় সুবিধা। চুক্তি অনুযায়ী চার মাস পরপর গরু বিক্রি করে যা লাভ হবে, তা প্রতিষ্ঠান ও মাকছুদার মধ্যে সমান ভাগ হবে। প্রথম চার মাসেই মাকছুদা ৩০ হাজার টাকা লাভের ভাগ পান। বছরে চারবার গরু বিক্রি করেন। এভাবে তাঁর বার্ষিক আয় দাঁড়ায় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। তহবিল ছাড়া শুধু পরিশ্রম করেই মাসিক আয় হচ্ছে ১০ হাজার টাকার বেশি।
মাকছুদার বড় মেয়ে আঁখি আক্তার এখন অষ্টম ও মেজ মেয়ে মায়া আক্তার ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। সবার ছোট মারিয়া। বয়স এক বছর। মাকছুদা বেগম বললেন, ‘হামরা ভালো আচি। গরু পালনের আয় দিয়া বাড়ি পাকা করচি, বাড়িত কারেন (বিদ্যুৎ) নিচি। বেটি তিনটেক নেকাপড়া করব্যার নাগচি। ওভাব আর হামারঘরোক কিচু করব্যার পায় না।’
মাকছুদা বেগমের মতো ধাপেরহাট ইউনিয়নের গরু পালন করেন মোংলাপাড়া গ্রামের পারুল বেগম (৩৮)। স্বামী নুরুল মণ্ডল কৃষিশ্রমিক। তিন ছেলে নিয়ে পাঁচ সদস্যের সংসার। দুই বছর আগে যোগ দেন সর্বজয়া প্রকল্পে। তখন থেকে গরু পালন করে তাঁর মাসিক আয় হচ্ছে ১৫ হাজার টাকা। পারুল বেগম বললেন, ‘হামার সোয়ামির কামলার কাম ঠিকমতো চলে না। সোংসারোত কসটো আচিলো। একন ক্যাস (মূলধন) ছাড়া গরু পালি। পোত্তেক মাসোত ১৫ হাজার ট্যাকা পাবার নাগচি। হামরা ভালো আচি।
একই গ্রামের গোলাপি বেগম (৩৮)। স্বামী আজাদ মিয়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তাঁদের এক ছেলে ও এক মেয়ে স্নাতক শ্রেণিতে পড়েন। স্বামীর আয়ে সংসারের যাবতীয় ব্যয় মেটানো কষ্ট হয়। গোলাপি বেগমও এক বছর আগে তিনটি গরু নেন। তিনি বলেন, ‘সেগুলো লালনপালন করে মাসিক ১২ হাজার টাকা আয় হয়েছিল। আরও গরু নিয়েছি। এখন সংসারের খরচ জোগানোর পরও ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ দিচ্ছি।’
সর্বজয়া প্রকল্পের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তাঁরা একজন নারীকে তিন থেকে আটটি পর্যন্ত দুই বছর বয়সী গরু কিনে দেয়। চিকিৎসাসেবা ও খাবারও দেওয়া হয়। এসব গরু চার মাস লালনপালন করে মোটাতাজা করেন নারীরা। এরপর গরু বিক্রি করা হয়। এভাবে বছরে তিন দফায় গরু বেচাকেনা হচ্ছে। তাদের এই প্রকল্পের গরুর মাংস বিক্রয়ে সহায়তা করে আমার ফুড ও গুডমিট। পাশাপাশি ঈদুল আজহায় এই প্রতিষ্ঠান দুটির মাধ্যমে ঢাকা এবং কিছু বিভাগীয় শহরের গ্রাহকেরা অনলাইনে সর্বজয়া প্রকল্পের নারীদের পালন করা গরু কেনার সুযোগ পান। এবারও এ সুযোগ থাকছে।