1. [email protected] : admin :
  2. [email protected] : জাতীয় অর্থনীতি : জাতীয় অর্থনীতি
বুধবার, ০৮ জানুয়ারী ২০২৫, ০১:৩৭ অপরাহ্ন

চট্টগ্রামে শতবর্ষী পুকুর ভরাট করে বহুতল ভবন নির্মাণের পাঁয়তারা

রিপোর্টার
  • আপডেট : মঙ্গলবার, ৭ জানুয়ারী, ২০২৫
চট্টগ্রামে শতবর্ষী পুকুর ভরাট করে বহুতল ভবন নির্মাণের পাঁয়তারা
•১০টি আবাসিক কাম বাণিজ্যিক বহুতল ভবনের পরিকল্পনা • অভিযোগের তীর সিডিএ’র দিকে • গুগল ম্যাপ দেখে পুকুরের ওপর ভবন নির্মাণের ভূমি ছাড়পত্র দেয় সিডিএ • সাত কোটি টাকা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ।

গাজী গোফরান, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম নগরীর শুলকবহর মৌজার ঐতিহ্যবাহী বালতি কোম্পানির পুকুর ভরাট করে ১৪ তলা বিশিষ্ট ১০টি বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের পরিকল্পনায় কাজ শুরু করেছে সংঘবব্ধ একটি চক্র। ইতিমধ্যে এ জলাধারা ও পুকুর ভরাট করার পর ভবন নির্মাণে প্রাথমিকভাবে ভূমি ছাড়পত্র দিয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। নকশা অনুমোদনের জন্য ফাইল প্রস্তুত করে বিশেষ প্রস্তাবনায় রাখা হয়েছে। চলতি  জানুয়ারি মাসেই সিডিএ’র বোর্ড নকশা অনুমোদন দেওয়ার কথা রয়েছে। এর পরই শুরু হবে এসব ভবনের নির্মাণ কাজ।

অভিযোগ উঠেছে, ২০০ বছরের প্রাচীন ‘বালতি কোম্পানির পুকুরের’  জমিকে বাণিজ্যিক এবং আবাসিক এলাকায় রূপান্তর করে আবাসিক কাম বাণিজ্যিক একাধিক বহুতল ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা চলছে। এ কাজে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) এবং স্থানীয় প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের ‘বনের মোষ তাড়িয়ে ঘরে বসে ভাত খাওয়া’ ধরনের ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দুর্নীতি স্পষ্ট। একই জায়গায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ২০ শতক জমি জোর করে দখল করে রাখারও অভিযোগ পাওয়া গেছে। জোরপূর্বক দখলে রাখা সেই জমি নিয়ে আদালতে মামলা করেছে ভুক্তভোগীরা। যা আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।

সরেজমিনে অনুসন্ধান

সরেজমিনে অনুসন্ধানে জানা যায়, বহদ্দারহাটের শুলকবহর মৌজার আরএস দাগ নং ৭৩১ (অংশ), ৭৩৬ (অংশ), ৭৪০ (অংশ), ৭৪১ (অংশ), ৭৪৫ (অংশ), ৭৪৬ (অংশ), ৭৪৯ (অংশ), ৭৫০ (অংশ), এবং বিএস দাগ নং ৭০৭ (অংশ), ৭১০ (অংশ), ৭১১ (অংশ), ৭১২ (অংশ), ৭৭৩ (অংশ) সমন্বয়ে মোট ১০,৫০০.৫৭ বর্গমিটার (প্রায় ২.৫৯ একর) জমি রয়েছে। বিএস মৌজা ম্যাপ অনুযায়ী, দাগ নং ৭১১ এবং ৭৭৩ পুকুর হিসেবে চিহ্নিত। তবে সিডিএর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা গুগল মানচিত্রের তথ্যের দোহাই দিয়ে উক্ত ভূমির ছাড়পত্র দিয়েছেন, যা সম্পূর্ণ বেআইনি। ‘লজ্জার মাথা খেয়ে কাজ করা’ এই কর্মকাণ্ড সিডিএ’র দুর্নীতির প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে।

ঘুষ আর প্রভাবের খেলায় বদলে গেল জমির চরিত্র

নগরীর শুলকবহর মৌজার ৭১১ ও ৭৭৩ নম্বর দাগের ৪৫ শতক বিশাল আয়তনের জলাধার এবং পুকুর ২০২১ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে রাতের আঁধারে অবৈধভাবে মাটি, বালি এবং ভাঙা বিল্ডিংয়ের কংক্রিট দিয়ে ভরাট করা হয়েছে।
বালতি কোম্পানির পুকুর নামে পরিচিত এই পুকুরের পার্শ্ববর্তী শাহ আমানত হাউজিং সোসাইটির এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “আমমোক্তার নামীয় হাজী মোঃ জামসেদ আলম গং ‘৭১১ এবং ৭৭৩ নং দাগের পুকুর রাতের আঁধারে মাটি দিয়ে ভরাট করেছে। পুকুর দুটি বাউন্ডারির ভিতরে থাকায় রাতের আঁধারে খুব সহজে ভরাট করতে সক্ষম হয়েছে। পুকুর ভরাটের পর জানতে পারি , এখানে ১০টির মত আবাসিক কাম বাণিজ্যিক বহুতল ভবন নির্মাণ করা হবে। আমাদের জমি-জমার কাগজপত্র ঠিক থাকার পরেও ভবন নির্মাণের জন্য সিডিএর অনুমোদন নিতে যেখানে হিমশিম খেয়েছি, অথচ এখানে হাতে কড়ি, ফকিরি বড়ি নিয়মে পুকুরের শ্রেণি পরিবর্তন না করে হাজী জামসেদ গং বহুতল আবাসিক কাম বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের জন্য মাত্র ৮ মাসের মাথায় সিডিএ থেকে ভূমি ছাড়পত্র নিয়ে নিলো। নিশ্চয়ই মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে এই কাজ হয়েছে।”

জমির মালিকানা নিয়ে প্রশ্ন

বিষয়টি অনুসন্ধান করতে গিয়ে প্রতিবেদকের সাথে যোগাযোগ হয় চট্টগ্রাম শহরে নাম-ডাকওয়ালা জমিজমার এক ব্রোকারের সাথে। তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “মোহাম্মদ আলী ফখরী একজন বিহারি। তিনি দীর্ঘদিন যাবত বাংলাদেশে নেই। ধারণা করা হচ্ছে, ফখরী বসবাস করেন আমেরিকা কিংবা লন্ডনে। স্ব-সশরীরে ফখরী আদতে জামসেদ গংদের আমমোক্তার দিয়েছে কিনা তা নিয়েই যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।”

 অর্থের বিনিময়ে ভূমি ছাড়পত্র দিলো সিডিএ!

সিডিএ’র একটি সূত্র জানায়, নগরের শুলকবহর মৌজার ‘৭১১ এবং ৭৭৩ নং দাগে জলাধার ও পুকুর ২০২১ সাল থেকে আজ অবধি রাতের আঁধারে মাটি ও বালি দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। গত এক বছর পূর্বে বাউন্ডারির ভেতরে থাকা পাশাপাশি বিশাল আয়তনের দুটি পুকুর ভরাট করা হয়। ইতিমধ্যে  আট মাস পূর্বে রাতের আঁধারে কোনো ধরনের বাঁধা ছাড়াই ভরাটের পর ভূমি ছাড়পত্র দিয়েছে সিডিএ। এখন নকশা অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ৩ কোটি টাকার বিনিময়ে এই ভূমি ছাড়পত্র দিয়েছে, যা অস্বাভাবিক এবং অবৈধ প্রক্রিয়া। ৪ কোটি টাকার বিনিময়ে নকশা অনুমোদনের জন্য ফাইল প্রস্তুত করে বিশেষ প্রস্তাবনায় রাখা হয়েছে। প্রকল্পের নকশা অনুমোদনের জন্য সিডিএ’র বোর্ড আসন্ন জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে অনুমোদন দিতে পারে, যা এই অবৈধ কার্যক্রমের একটি অংশ। ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্র পাওয়া প্রকল্পটি কাপাসগোলা রোড (পুরাতন আরাকান রোড) সংলগ্ন অবস্থিত। এদিকে আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বহুতল আবাসিক কাম বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করার কথা শুনে স্থানীয়দের মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করছে। ভু-ব্য-২০৯৪/২২-২৩ এর নথি নং মূলে মোহাম্মদ আলী ফখরী নিযুক্ত আমমোক্তার নামা মূলে হাজী মোঃ জামসেদ আলম গং (১৪ জন) আবেদনকারী ২০২৩ সালের ২৫ মার্চ এ ভূমির ছাড়পত্রের জন্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) বরাবর আবেদন করেন। ৩ কোটি টাকা ঘুষের বিনিময়ে আবেদনটি নিষ্পত্তি করে তাদের পক্ষে সিডিএ ভূমি ছাড়পত্র প্রদান করেন একই বছরের ২৭ নভেম্বর।

পরিবেশবাদী সংগঠনের উদ্বেগ

জানা যায়, জলাধার ও পুকুর ভরাট করতে অবৈধভাবে মাটি, বালি এবং ভাঙা বিল্ডিংয়ের কংক্রিট ব্যবহার করা হয়েছে, যা পরিবেশগতভাবে ক্ষতিকর। পরিবেশবাদী সংগঠন শিক্ষা, শ্রম, বন ও পরিবেশ রক্ষা সোসাইটির চট্টগ্রাম শাখা এ বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সংগঠনের সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ আবদুল ওয়াহেদ হোছাইনী বলেন, ‘চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী জলাধারগুলো দখল আর ভরাট হয়ে যাচ্ছে। পুকুরগুলো ভরাট করে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হলে এ অঞ্চলে জলাবদ্ধতা মারাত্মক আকার ধারণ করবে। এটি পরিবেশ ও মানুষের জীবনের ওপর এক ভয়াবহ প্রভাব ফেলবে। সিডিএ’র এমন সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে, তারা পরিবেশ রক্ষার পরিবর্তে ধ্বংসকে উৎসাহিত করছে। আমরা অবিলম্বে এই প্রকল্প বন্ধের দাবি জানাই এবং দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি।’

 স্থানীয় জনসাধারণের ক্ষোভ

স্থানীয়রা মনে করেন, ‘চোরের দশ দিন, গৃহস্থের এক দিন’—যতই চেষ্টা করা হোক, এই বেআইনি কর্মকাণ্ডের পরিণতি হবে আইনের আওতায় আসা। কিন্তু সিডিএ’র কর্মকর্তারা ‘দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো’ নীতিতে কাজ করছেন, যা পরিবেশ রক্ষার পরিবর্তে কেবল দুর্নীতিকে উৎসাহিত করছে।

সিডিএ’র একটি সূত্র জানায়, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ৩ কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্র আদায় করা হয়েছে। এই কাজে সরাসরি জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। এটি বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক পরিচয়ে গড়ে উঠা একটি ‘জোর যার, মুল্লুক তার’ নামক সিন্ডিকেট। সিডিএ’র ক্ষমতাসীন কর্মকর্তারা এই প্রকল্পের নেপথ্যে ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। উপ-প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আবু ঈসা আনছারী এবং তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা এই প্রকল্পের সব আইনি প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে দিয়েছেন বলে অভিযোগ। স্থানীয়দের মতে, ‘বাঘে ধরলে ছাড়ে, কিন্তু সিডিএ ধরলে ছাড়ে না।’

স্থানীয় বাসিন্দারা ঝুঁকির মুখে

শুলকবহর মৌজার বালতি কোম্পানির পুকুর ভরাটের কারণে এলাকায় ভয়াবহ জলাবদ্ধতা, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হ্রাস, এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধির শঙ্কা রয়েছে। এভাবে প্রতিনিয়ত জলাধার ভরাট হলে নিকাশী ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে, যা বাসিন্দাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে আরও দুর্বিষহ করে তুলবে। এছাড়া, বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্যহীনতা ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের এ ধরনের কর্মকাণ্ড তাদের সম্পত্তি ও অধিকার ক্ষতিগ্রস্ত করবে বলে তারা উদ্বিগ্ন। বাসিন্দারা দ্রুত এই বেআইনি কার্যক্রম বন্ধে প্রশাসনের কার্যকর পদক্ষেপ দাবি করেছেন।

অভিযোগ প্রসঙ্গে জানার জন্য উপ-প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আবু ঈসা আনছারীকে একাধিকবার  কল ও হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

একই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী (ভারপ্রাপ্ত), তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী-১ কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘আপনি আবু ঈসা আনছারী সাহেবের সাথে যোগাযোগ করুন। এই বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারবো না— বলে ফোন কেটে দেন তিনি।’

এ বিষয়ে সিডিএ’র অথরাইজড অফিসার-১ মোহাম্মদ হাসানের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘ভূমি ছাড়পত্রের বিষয়টি আমি দেখি না। এসব দেখেন আবু ঈসা আনছারী সাহেব। আপনি তার সাথে যোগাযোগ করলে তিনি ভালোই বলতে পারবেন, কিভাবে চিহ্নিত পুকুরের শ্রেণি পরিবর্তন ছাড়া ভূমি ছাড়পত্র দিয়েছেন।’

Please Share This Post in Your Social Media

এই বিভাগের আরো সংবাদ
© ২০২০ দৈনিক জাতীয় অর্থনীতি