মানবপাচার থেকে শুরু করে চুরি, দখলবাজি, প্রতারণা, টেন্ডারবাজি, জালিয়াতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়লেও রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। নিজের ছেলে এবং আত্মীয়-স্বজন নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন এক অপরাধ সাম্রাজ্য। তারা অক্টোপাসের মতো চুষে খাচ্ছেন পটিয়া ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা।
হুইপ শামসুল হক চৌধুরী ওরফে বিচ্ছু শামসু এক সময় চট্টগ্রাম আবাহনী ক্লাবের সদস্য সচিব ছিলেন। সেই ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে তিনি গড়ে তোলেন মানবপাচার চক্র। এমনকি নিজের ছেলে খোলেয়াড় না হলেও তাকে খেলোয়াড় সাজিয়ে নিয়ে যান লন্ডনে।
২০০২ সালের ২২ আগস্ট দেশের প্রথম সারির পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চট্টগ্রাম আবাহনী লিমিটেডের গোপনে লন্ডন যাওয়া দলের তালিকায় ক্লাবের সদস্য সচিব শামসুল হক চৌধুরী ওরফে বিচ্ছু শামসুর ছেলেও ছিল। ছেলেকে বিদেশে নেওয়ার জন্য তিনি জালিয়াতির আশ্রয় নেন। মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সিনিয়র সহকারী সচিব আবদুর রাজ্জাক হাওলাদার স্বাক্ষরিত সরকারি অনুমোদনপত্রে শামসুপুত্র নামজুল করিম চৌধুরী শারুনের নাম ‘খেলোয়াড়’ হিসেবে দেখানো হয়।
চট্টগ্রাম আবাহনীর বিদেশ সফরের আড়ালে আদমপাচার কেলেঙ্কারি প্রকাশ হয়ে পড়লে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্যরা ক্লাবের তৎকালীন সভাপতি ও আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মরহুম রফিকুল আনোয়ারের সঙ্গে দেখা করে আদম পাচারের অন্যতম নায়ক শামসুল হক চৌধুরী ওরফে বিচ্ছু শামসুকে সদস্য সচিব পদ থেকে সাময়িকভাবে অব্যাহতি দেওয়ার অনুরোধ জানান।
তদন্ত দল লন্ডনগামী ৩৮ জনের দলে অন্তত ১১ জনকে আদম হিসেবে পাচার করার প্রাথমিক প্রমাণ পায়। জালিয়াতির মাধ্যমে যাদের পাচার করা হয় তাদের নামও প্রকাশ করা হয়। এরা হলেন- ঢাকার মাহাবুবুল আলম, গিয়াস উদ্দিন মিয়াজি, আনিসুর রহমান চৌধুরী, সাহাবুদ্দিন, চট্টগ্রামের এম এন শাকিল, আরিফ মাহমুদ, নূরুল আফসার মিন্টু, চাঁদপুরের শফিকুল ইসলাম, নারায়ণগঞ্জের বদরুল ইসলাম দৌজা প্রমুখ।
ক্ষমতার অপব্যবহার করে শুধু আদম পাচারই নয়, ক্লাবের অর্থও লোপাট করেন বারবার দল পাল্টানো সুবিধাবাদী বিচ্ছু শামসু। জানা যায়, তার স্বাক্ষরে ব্যাংকে জমাকৃত আবাহনী ক্লাবের ১ কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, শামসুল হক চৌধুরী টানা দ্বিতীয়বার এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে পটিয়া এলাকায় অপরাধ জগতে ডালপালা মেলতে থাকে তার পরিবার। জাতীয় সংসদের হুইপ নির্বাচিত হওয়ার পর তা আরও মারাত্মক আকার ধারণ করে। এরপর থেকে এলাকার টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, উন্নয়ন কাজে রড, বালু, পাথর সরবরাহ, বালুমহাল নিয়ন্ত্রণ, শিল্প কারখানায় কাঁচামাল ও শ্রমিক সরবরাহ, মাদক ব্যবসাসহ সব সেক্টরে ভাগ বসায় হুইপপুত্র ও তার ভাই-বোনেরা। এসব ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে খুনের ঘটনাও ঘটেছে। এসব ঘটনার নেপথ্যে থাকার অভিযোগ রয়েছে হুইপ পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে।
নিজের বাসার বাবুর্চিকে মালিক সাজিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে অন্যের জমি আত্মসাৎ করার অভিযোগও আছে পটিয়া আসনের এমপি বিচ্ছু শামসুর বিরুদ্ধে।
দলে তাকে নিয়ে অসন্তোষ বাড়ছে। পটিয়া আওয়ামী লীগের নেতারা তাকে আর না চাইলেও ভয়ে কথা বলার সাহস রাখেন না।
দীর্ঘদিন ধরে অপকর্ম করে আসা শামসুল হক চৌধুরী ওরফে বিচ্ছু শামসুর পুরো জীবনটাই জালিয়াতিতে ভরা বলে দাবি করেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা দিদারুল আলম চৌধুরী।
ক্যাসিনোকাণ্ড থেকে শুরু করে সরকারের শুদ্ধি অভিযান- সব জায়গায় নাম আসে এই হুইপের।
অবৈধ উপায়ে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন, এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তার সম্পদের অনুসন্ধানে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কিন্তু দু’বছর কেটে গেলেও এখনো অনুসন্ধান চলছে বলে জানিয়েছে দুদক।
শত বছরের পুরনো পটিয়া থানা মসজিদ দখল করে বহুতল মার্কেট নির্মাণের অভিযোগও উঠেছে বিচ্ছু শামসু ও তার ছেলে শারুনের বিরুদ্ধে।
শুধু তাই নয়, নিজের কার্যসিদ্ধির জন্য পাল্টে দিয়েছেন মসজিদের নামও। এমন অনৈতিক কার্যকলাপের প্রতিবাদ করায় হুইপ ও তার পুত্রের রোষানলে পড়েছেন পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা। পটিয়া থানা পুলিশের মসজিদ দখল করে বহুতল মার্কেট নির্মাণকে কেন্দ্র করে পুলিশ প্রশাসনে দেখা দিয়েছে তীব্র অসন্তোষ।
সম্প্রতি চট্টগ্রামে তরুণ ব্যাংকার আবদুল মোরশেদ চৌধুরীকে আত্মহত্যার প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে হুইপপুত্র শারুলের বিরুদ্ধে। মোরশেদ চৌধুরীর স্ত্রী ইশরাত জাহান চৌধুরী শারুলসহ কয়েকজনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেছেন। কিন্তু ১১ দিন কেটে গেলেও আসামিদের কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।