নিজস্ব প্রতিবেদক :
স্থানীয় এমপি হাজী সেলিমের দখলে এখানো পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলীর ওয়াইজঘাটের ৮ ও ৯ নম্বর জিএল পার্থ লেনে ৮ দশমিক ৮৮৯ কাঠা জমির ওপর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘তিব্বত হল’টি । ছাত্রদের দফায় দফায় আন্দোলন ও সরকারের উপর মহলের আশ্বাসের পরও হাজী সেলিমের কাছ থেকে হলটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ২০০১ সালে তিনি হলটির অবকাঠামো বদলে ফেলে ১০তলা বিশাল ভবন নির্মাণ করে স্ত্রীর নামে ‘গুলশান আরা সিটি মার্কেট’ গড়ে তোলেন।
এই মার্কেটে প্রায় এক হাজার দোকান রয়েছে। জগন্নাথের বেদখল হয়ে যাওয়া প্রায় ১১টি হলের মধ্যে তিব্বত হল একটি। এসব হল উদ্ধারে দফায় দফায় জগন্নাথের ছাত্ররা আন্দোলন গড়ে তুললেও ২০১৪ সালে সপ্তাহব্যাপী সবচেয়ে বড় আন্দোলনের পরও কাজের কাজ কিছু হয়নি। বরং বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে মারধর করে ছাত্র আন্দোলন নস্যাৎ করে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে হাজী সেলিমের বিরুদ্ধে।
জানা যায়, ঢাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের অর্পিত সম্পত্তি শাখার (স্মারক জেপ্রঢা/অর্পিত/১১৮৩) তথ্য অনুযায়ী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেদখলকৃত হলগুলোর মধ্যে ‘তিব্বত হল’ একটি। ২০০৯ সালে ঢাকা জেলা প্রশাসকের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ তিব্বত হলটি উদ্ধারে সহযোগিতা চেয়ে চিঠি পাঠায়।
ওই চিঠিতে প্রায় ১৪ হাজার বর্গফুটের যে খালি জায়গাটি (তিব্বত হল) অবৈধ দখলদার কর্তৃক ব্যবহৃত হচ্ছে, প্রশাসনের সহযোগিতায় তাদের উচ্ছেদ করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণের অনুরোধ করা হয়। কিন্তু আজও প্রশাসনের পক্ষে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
এর প্রেক্ষিতে ২০১৪ সালে জগন্নাথের শিক্ষার্থীরা হলটি ‘ঘেরাওয়ে’ গেলে হাজী সেলিমের সমর্থকরা হামলা করে এবং পুলিশ লাঠিপেটা ও গুলি করে। ওইদিন ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান নাসিরউদ্দীন গুলিবিদ্ধসহ তিন শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন।
কঠোর অবস্থানে সরকার
সরকারি জমিসহ হাজী সেলিমের একের পর এক দখলদারি ও চাঁদাবাজির ঘটনায় বিস্মিত সরকারের হাইকমান্ড। এত অন্যায়-অপরাধ করেও এমপি সেলিম ও তার ছেলে কীভাবে ধরাছোঁয়ার বাইরে-তা নিয়েও খোঁজখবর নিচ্ছেন সরকারের সংশ্লিষ্টরা।
এই এমপিসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারি দলের নাম ভাঙিয়ে যারা দখলদারি, চাঁদাবাজিসহ ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছেন, তাদের বিরুদ্ধেও ‘কঠোর অ্যাকশনে’ যাওয়ার ‘মেসেজ’ রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে। সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশনা হল-‘অপরাধ করলে এমপি হলেও ছাড় নয়।’
ফলে নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে মারধরের ঘটনায় ছেলে ইরফান সেলিম আটকের পর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোয় ধরনা দিয়েও সাড়া পাচ্ছেন না হাজী সেলিম।
সে কারণে আদালতের বিচারেই ফয়সালা হবে ইরফানের ভাগ্যে কী রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারণী সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
ইরফান সেলিম ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৩০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর (সাময়িক বরখাস্ত)। তার বাবা ঢাকা-৭ আসনের ক্ষমতাসীন দলের এমপি। শ্বশুর নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর আসনের এমপি মোহাম্মদ একরামুল করিম চৌধুরী। ফলে শুধু বাবার দিক থেকে নয়; বরং শ্বশুরের দিক থেকেও ক্ষমতাধর ছিলেন ইরফান সেলিম।
জানা যায়, দীর্ঘদিন কানাডায় থাকা ছেলে ইরফান সেলিম দেশে ফিরে ৩০নং ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে হারিয়ে কাউন্সিলর হন। মূলত তখন থেকেই চকবাজার এলাকায় ক্ষমতার জাল বিস্তার করে জমি দখলসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাÐ শুরু করেন তিনি। গড়ে তোলেন নিজস্ব ‘নেটওয়ার্কিং সিস্টেম’ ও অন্তত অর্ধশত সদস্যের ‘স্পেশাল গার্ড’। তবে এসব কাজে কখনও কেউ তার বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। তাই অতীতের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা থেকেই গ্রেফতারের সময় স্বাভাবিক ছিল ইরফান।
মদিনা আশিক টাওয়ারে এই ইরফান সেলিমের টর্চার সেলের সন্ধান পায় র্যাব। চাঁদাবাজি ও দখলদারিতে এই টর্চার সেলের ব্যবহার হয়েছে বলে জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক এবং মুখপাত্র লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্র বলছে, শুধু হাজী সেলিম ও তার ছেলে নয়; বরং দখলদারি ও চাঁদাবাজিতে যারা তাদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করত, তারাও রয়েছেন নজরদারিতে। সেটা উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা হোক অথবা যেই হোক।
এদিকে ইরফান সেলিমের বিষয়ে পুলিশের শক্ত অবস্থানের কথা জানা যায় ডিএমপি কমিশনারের বক্তব্য থেকেও। মঙ্গলবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘নিঃসন্দেহে এই মামলা প্রভাবমুক্তভাবে তদন্ত করা হবে। এখানে প্রভাব খাটানোর চেষ্টাও কেউ করবে না। একজন অপরাধীকে যেভাবে বিচারের আওতায় আনা দরকার, একইভাবে তাকেও আনা হবে।’
যে দলেরই হোক, অপরাধীকে শাস্তি পেতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর। এ বিষয়ে দলের তৃণমূলসহ সব পর্যায়ে কঠোর বার্তাও দেয়া হয়েছে।
এদিকে ক্ষমতাসীন দলের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, অভিযানের কথা শুনে তার পরিবারের পক্ষ থেকে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে লবিং-তদবিরের চেষ্টা করা হয়। তবে তাতে কাজ হয়নি। কেউ কেউ তার পরিবারের কারও ফোনই ধরেনি। অনেকে কল ধরলেও এ বিষয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।