নিজস্ব প্রতিবেদক : ভাস্কর্য নিয়ে চলমান বিতর্ককে প্রথম দিকে হালকাভাবে নিলেও এখন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টিকে দেখছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ভাস্কর্য নিয়ে ইসলামের সঠিক ব্যাখ্যা, আইনগত পদক্ষেপ এবং প্রগতিশীল ইসলামী চিন্তাবিদদের মতামত তুলে ধরে জনমত গঠন করে বিতর্কের অবসান চায় ক্ষমতাসীন দলটি।
কুষ্টিয়ায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভাঙচুরের পর এ বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারণী মহলেও খোঁজা হচ্ছে এর কার্যকর সমাধানের কৌশল। ইতোমধ্যেই দলের শীর্ষ ফোরামে এ নিয়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, ‘সারা মুসলিম বিশ্বেই ভাস্কর্য রয়েছে। মিসর, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশে অনেক শৈল্পিক ভাস্কর্য রয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি ভাস্কর্য নিয়ে যে অপব্যাখ্যা করা হয়েছে তা মূলত রাজনৈতিক। এর মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্তও আছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘জনগণকে বিভ্রান্ত করে ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে একটা কৃত্রিম অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির ষড়যন্ত্র হয়েছিল। একমাত্র জনগণই পারে এদের রুখে দিতে। সে কারণে তাদের যেমন সঠিক ইতিহাস জানতে হবে, তেমনি ধর্মের সঠিক বিধানও জানাতে হবে। তা করতে পারেন আলেম-ওলামারাই। কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুরকারীরা ইতোমধ্যেই আইনি হেফাজতে আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যে আঘাত করে জাতির মর্মমূলে আঘাত করা হয়েছে। এর যথাযথ ব্যবস্থা অবশ্যই নেওয়া হবে।’
প্রসঙ্গত, ইসলামে ভাস্কর্য নির্মাণ ‘নিষেধ’ দাবি করে গত ১৩ নভেম্বর এক সমাবেশে তা বন্ধের দাবি তোলেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ও বাংলাদেশ খেলাফত যুব মজলিসের কেন্দ্রীয় সভাপতি মাওলানা মামুনুল হক। এ নিয়ে সরকারকে হুঁশিয়ার করে বলেছিলেন, ভাস্কর্য নির্মাণ পরিকল্পনা থেকে সরে না দাঁড়ালে তিনি আরেকটি শাপলা চত্বরের ঘটনা ঘটাবেন এবং ওই ভাস্কর্য ছুড়ে ফেলবেন। এরপর তার দাবির সমর্থনে মাঠে নামে ধর্মভিত্তিক কিছু রাজনৈতিক-সামাজিক সংগঠন। ক্রমেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠতে থাকে। সরকারের পক্ষ প্রথম দিকে বিষয়টিকে আমলে নেওয়া হয়নি। আওয়ামী লীগ আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও প্রতিক্রিয়া না দেখালেও দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তখন বলেছিলেন, তারা বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছেন।
গত দুই ডিসেম্বর বুধবার মধুর ক্যান্টিনে ‘মধুদা’র ভাস্কর্যের কান ভাঙা অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায়। তারপর গত শুক্রবার রাতে (৪ ডিসেম্বর) কুষ্টিয়ায় ভাঙচুর করা হয় বঙ্গবন্ধুর নির্মাণাধীন একটি ভাস্কর্য। এ নিয়ে দেশব্যাপী দেখা দেয় বিরূপ প্রতিক্রিয়া। সরকার ও আওয়ামী লীগ নড়েচড়ে বসে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের হুঁশিয়ারি দেন ‘অনেক হয়েছে, এবার থামুন’। ধর্ম প্রতিমন্ত্রী দ্রুত বিষয়টির সমাধান হবে বলে বক্তব্য দেন। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া ও প্রধানমন্ত্রীর উপ প্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকন বিভিন্ন মাধ্যমে ভাস্কর্য নিয়ে বক্তব্য ও ইতিহাস তুলে ধরেন।
ভাস্কর্য বিষয়ে ব্যাখ্যা নিয়ে হাজির হন ওলামা-মাশায়েখরাও। ভাস্কর্যকে মূর্তি বলা জ্ঞানের স্বল্পতা বলে বিবৃতি দেয় ওলামা লীগ। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন ওলামা লীগের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য সচিব মুফতি মাসুম বিল্লাহ নাফিয়ী, মুখপাত্র ক্বারি মাওলানা আসাদুজ্জামান, যুগ্ম আহ্বায়ক হাফেজ মাওলানা আনোয়ার হোসেন জুয়েল, মুফতি আব্দুল আলিম বিজয়নগরী, পীরে তরীকত সূফী মাঞ্জুর আহমেদ, পীরে তরীকত মুফতিয়ে আজম নজরুল ইসলাম রেজভী, মাওলানা জাকারিয়া আল কাদেরী, সুফি আব্দুল করিম ও মুফতি তৈয়বুর রহমান প্রমুখ। প্রতিবাদ-বিক্ষোভ এবং ভাস্কর্য নিয়ে সঠিক ব্যাখ্যার পর অনেকটাই দমে যায় ভাস্কর্যবিরোধীরা।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী ফোরাম সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘দলের উচ্চপর্যায়েও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ভাস্কর্যকে মূর্তি বলে বিচারের সুযোগ নাই। এটা শিল্প। কেউ যদি কোনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকে এটা প্রচার করে বা ধর্মীয় দিক থেকে অপব্যাখ্যা দেয়, তা ঠিক হবে না। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে।’