নানা ছাড়ের পরও দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরো বেড়েছে। এটিকে স্পষ্ট করতে খেলাপি ঋণের মেয়াদ গণনার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানদণ্ড ব্যাসেল-৩-এর নীতিতে ফিরছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগামী জুনের মধ্যেই এ মানদণ্ডে ফেরার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। সবকিছু ঠিকঠাক এগোলে চলতি মাসের মধ্যেই এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
বর্তমানে দেশের ব্যাংক খাতে কোনো ঋণ ৯০ দিন অপরিশোধিত থাকার পর মেয়াদোত্তীর্ণ হিসেবে স্বীকৃত হচ্ছে। আর সাব-স্ট্যান্ডার্ড মানে শ্রেণিকৃত হতে সময় লাগছে ২৭০ দিন। মন্দ মানের খেলাপি হতে ১৫ মাসেরও বেশি সময় লাগছে। মেয়াদ গণনার এ নীতিছাড়ের কারণে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি হিসেবে বিবেচনাযোগ্য বিপুল পরিমাণ ঋণও নিয়মিত দেখাচ্ছে। এর মাধ্যমে খেলাপি হওয়া থেকে বেঁচে যাচ্ছেন অনেক ঋণগ্রহীতা। আর ব্যাংকগুলোও খেলাপি ঋণের হার ও পরিমাণ কম দেখানোর সুযোগ পাচ্ছে।
খেলাপি ঋণের মেয়াদ গণনায় আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ফিরতে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ডেপুটি গভর্নরের নেতৃত্বে একটি কমিটি কাজ করছে। ওই কমিটির দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘ব্যাসেল-৩ অনুসরণের স্বার্থেই খেলাপি ঋণ গণনায় আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ফিরতে হবে। আবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকেও এ বিষয়ে সুপারিশ রয়েছে। এ কারণে চলতি মাসেই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারির প্রস্তুতি চলছে। আগামী মার্চ না হলেও জুনের মধ্যে খেলাপির মেয়াদ গণনায় বিদ্যমান নীতিছাড় উঠে যাবে।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মেয়াদ গণনায় আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ হলে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক ধাক্কায় লাখ কোটি টাকা বেড়ে যেতে পারে। কভিড-১৯ সৃষ্ট দুর্যোগের পরিপ্রেক্ষিতে ঋণ পরিশোধে ব্যাপক মাত্রায় ছাড় দেয়া হয়েছিল। ওই সময় নীতিছাড়ের সুযোগ নিয়ে দেশের অনেক ব্যবসায়ীই ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করেননি। প্রদেয় কিস্তির ২৫ শতাংশ পরিশোধ করেও অনেকে ঋণ নিয়মিত রাখতে পেরেছেন। আবার নামমাত্র ডাউনপেমেন্ট দিয়েও প্রভাবশালীরা ঋণ পুনঃতফসিল করে নিয়েছেন। এখন আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ফিরলে বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত এমন অনেক ঋণই খেলাপির খাতায় উঠবে। এতে ব্যাংকগুলোর প্রভিশন বা সঞ্চিতি সংরক্ষণের চাপও বাড়বে। গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা।
২০১৪ সালের ২১ ডিসেম্বর প্রথম ব্যাসেল-৩ বাস্তবায়নের রূপরেখা ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই ঘোষণা অনুযায়ী, দেশের ব্যাংক খাতে ২০১৯ সালের মধ্যে ব্যাসেলে ঘোষিত নীতিগুলো বাস্তবায়ন হওয়ার কথা। কভিড-১৯ সৃষ্ট দুর্যোগ শুরু হওয়ার আগে ব্যাসেলের অনেক নীতির অনুসরণ শুরুও হয়েছিল। বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত এ মানদণ্ড অনুযায়ী, কোনো মেয়াদি ঋণের কিস্তি যেদিন পরিশোধ হওয়ার কথা, সেদিন পরিশোধ না হলে পরের দিন থেকেই সেটি মেয়াদোত্তীর্ণ বলে স্বীকৃত হবে। এ ধরনের মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ ৯০ দিন পার হলে শ্রেণীকৃত বা খেলাপি হিসেবে গণ্য হয়। সেক্ষেত্রে এ ঋণের মান হবে সাব-স্ট্যান্ডার্ড। এ ধরনের ঋণের বিপরীতে ২০ শতাংশ হারে সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হয়। আর কোনো ঋণ যদি ছয় মাস বা ১৮০ দিন অপরিশোধিত থাকে সেটির মান হয় ডাউটফুল। এ শ্রেণীর খেলাপি ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ হারে সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হয়। কোনো ঋণ নয় মাস বা ২৭০ দিন অপরিশোধিত থাকলে সেটি মন্দ বা খারাপ মানের ঋণের তালিকায় ওঠে। এ ধরনের ঋণের বিপরীতে শতভাগ সঞ্চিতি সংরক্ষণের বিধান রয়েছে। ঋণ বিতরণকারী ব্যাংকের অর্জিত পরিচালন মুনাফা থেকে সঞ্চিতি রাখতে হয়।
২০২০ সালে কভিডসৃষ্ট দুর্যোগের সময় খেলাপি ঋণের মেয়াদ গণনায় বেশ ছাড় দেয়া হয়। তখন বলা হয়, কোনো ঋণ অপরিশোধিত থাকার ৯০ দিন পার হলে তবেই সেটি মেয়াদোত্তীর্ণ বলে গণ্য হবে। আর মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ খেলাপি হবে আরো ২৭০ দিন পর। এভাবে সব শ্রেণীর খেলাপির মেয়াদ পিছিয়ে দেয়া হয়। ব্যাসেল-৩ অনুযায়ী নয় মাস অনাদায়ী থাকলে ওই ঋণ মন্দ মানের খেলাপি হওয়ার কথা। কিন্তু নীতিছাড়ের কারণে এ মানের খেলাপির মেয়াদ ১৫ মাসে গিয়ে ঠেকে।
অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, বাছবিচারহীন পুনঃতফসিল বন্ধ না হলে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ফিরেও কোনো উপকার হবে না।
তিনি বলেন, ‘কোনো ঋণ এক-দুইবার পুনঃতফসিল হলে সেটি মানা যায়। কিন্তু একই ঋণ বারবার পুনঃতফসিল করা হলে এ প্রক্রিয়াটির কোনো মর্যাদা থাকে না। দেশের ব্যাংক খাতে প্রভাবশালীদের ঋণ যত খুশি ততবার পুনঃতফসিল হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ফিরলেও ব্যাংক খাতের কোনো উপকার হবে না।’
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী যেদিন কিস্তি পরিশোধ করার কথা, সেদিন পরিশোধ না হলে পরের দিন থেকেই মেয়াদোত্তীর্ণ হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে মেয়াদোত্তীর্ণ দেখাতে ২৭০ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। বিদেশীরা এসে আমাদেরকে এ বিষয়ে নানা প্রশ্ন করে। তারা মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণকে খেলাপি হিসেবেই দেখতে চায়। দেশের ব্যাংক খাতের স্বার্থেই আমাদেরকে খেলাপি ঋণের মেয়াদ গণনায় আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করা উচিত। এটি হলে সাময়িকভাবে খেলাপি ঋণ বাড়লেও ব্যাংক খাত দীর্ঘমেয়াদে উপকৃত হবে। তবে খেলাপি ঋণ কমাতে হলে আইনি ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে। আদালত থেকে কোনো একটি আদেশ দেয়ার পর ছয় মাস লেগে যায় পরবর্তী শুনানির তারিখ পেতে। এভাবে চলতে থাকলে কখনই খেলাপি ঋণ কমানো সম্ভব হবে না।’
আহসান এইচ মনসুর জানান, ‘উন্নত বিশ্বের ব্যাংক খাতে এখন ব্যাসেল-৫ অনুসৃত হচ্ছে। আর আমরা এখনো ব্যাসেল-৩-এর নীতিতেই ছাড় দিয়ে চলছি। নীতি পালনে শিথিলতার কারণে ব্যাংক খাতের প্রকৃত চিত্র সামনে আসছে না। লাখ-লাখ কোটি টাকার খেলাপি ঋণকেও ব্যাংকগুলো নিয়মিত দেখানোর সুযোগ পাচ্ছে। আর এর মাধ্যমে ব্যাংক থেকে উদ্যোক্তারা মুনাফা বের করে নিচ্ছেন।’
নীতিছাড়ের পরও দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েই চলছে। একই ঋণ বারবার পুনঃতফসিল করে নিয়মিত দেখাচ্ছে ব্যাংকগুলো। খেলাপি ঋণ কম দেখাতে বাংলাদেশ ব্যাংকও পুনঃতফসিলের নীতি উদার করে দিয়েছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এখন চাইলে নিজেরাই যেকোনো ঋণ পুনঃতফসিল করতে পারছে। নীতিছাড়ের এ সুযোগে ব্যাংকগুলোও ঋণ পুনঃতফসিলের রেকর্ডও গড়েছে। শুধু ২০২২ সালেই ব্যাংকগুলোর পুনঃতফসিলকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ৬৩ হাজার ৭২০ কোটি টাকা। গত বছরও ব্যাংকগুলো রেকর্ড পরিমাণ ঋণ পুনঃতফসিল করেছে। তার পরও ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা, যা ব্যাংক খাতের বিতরণকৃত ঋণের ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
খেলাপি ঋণ গণনায় বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ডের চর্চা করলে সেটি দেশের ব্যাংক খাতের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে বলে মনে করেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান।
তিনি বলেন, ‘২০২৬ সালে এলডিসি তালিকা থেকে উত্তরণ ঘটবে বাংলাদেশের। এজন্য অন্যসব নীতির মতো খেলাপি ঋণ গণনার ক্ষেত্রেও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করা দরকার। সেটি হলে আমরা স্বাগতই জানাব।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সাল শেষে দেশের ব্যাংক খাতের পুনঃতফসিলকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ২ লাখ ১২ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা, যা ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত মোট ঋণের ১৪ দশমিক ৪০ শতাংশ। খেলাপি ও পুনঃতফসিলকৃত ঋণকে ‘স্ট্রেসড’ বা ‘দুর্দশাগ্রস্ত’ হিসেবে দেখায় আইএমএফ। এ হিসেবে দেশের ব্যাংকগুলোর ‘দুর্দশাগ্রস্ত’ ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ লাখ ৬৮ হাজার ১৭৭ কোটি টাকায়। অন্যদিকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আদায় অযোগ্য হওয়ায় ব্যাংকগুলো ৬৫ হাজার ৩২১ কোটি টাকার ঋণ অবলোপনও করেছে। সব মিলিয়ে দেশের ব্যাংক খাতের এক-চতুর্থাংশের বেশি ঋণ এখন দুর্দশাগ্রস্ত।