মুস্তাকিম নিবিড়ঃ
রাজধানী ঢাকার নেতৃত্বে এই পর্যন্ত যারাই ছিলেন, কেউই মেয়র মোহাম্মদ হানিফের মতো ঢাকাবাসীর হৃদয়ে জায়গা করে নিতে পারেন নি। বঙ্গবন্ধু পরিবারের প্রতি চরম আনুগত্য, ঢাকাবাসীর প্রতি পরম মমত্ববোধ ও নিজ কর্মগুণে খুব স্বল্প সময়েই দলমত নির্বিশেষে সকল ঢাকাবাসীর কাছে বনে গিয়েছিলেন প্রিয় “হানিফ ভাই”।
অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র ছিলেন মোহাম্মদ হানিফ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে যার রাজনীতিতে প্রবেশ তিনিই মোহাম্মদ হানিফ। ছাত্রাবস্থায় ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি।
পুরাতন ঢাকার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৪৪ সালের পহেলা এপ্রিল জন্ম তার। পিতা আবদুল আজিজ আর মাতা মুন্নি বেগমের ছোট ছেলে মোহাম্মদ হানিফ। আদর করে সবাই তাকে ‘ধনী’ নামে ডাকত। লোকমুখে শোনা যায় ছোটবেলায় মাকে হারানোর পর ফুফু আছিয়া খাতুনের কাছে বেড়ে উঠেন তিনি। ঢাকার প্রখ্যাত পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি ঢাকার সর্বশেষ সরদার আলহাজ্ব মাজেদ সরদারের কন্যা ফাতেমা খাতুনকে ১৯৬৭ সালে বিয়ে করেন মোহাম্মদ হানিফ। এই দম্পতির একজন পুত্র ও দুই কন্যা সন্তান রয়েছে। তার একমাত্র পুত্র সাঈদ খোকন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রাক্তন মেয়র। ১৯৬০ সালে পুরান ঢাকার ইসলামিয়া হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করে পরবর্তীতে তৎকালীন কায়েদে আযম কলেজে (বর্তমানে শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ) উচ্চ মাধ্যমিক এবং বিএ পরীক্ষায় সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হয়ে কিছুদিন আইন বিষয়ে লেখাপড়া করেন। মোহাম্মদ হানিফ ছাত্রাবস্থায় ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে তার রাজনীতির হাতেখড়ি। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ের পর পাকিস্তান সরকার যখন প্রাদেশিক সরকার ভেঙে দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে দূর্নীতির মামলায় গ্রেফতার করে এবং ২৪ ঘণ্টার নোটিশে শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারকে মন্ত্রীপাড়ার বাসা ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয়, ঠিক সেসময় কেন্দ্রীয় সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে মোহাম্মদ হানিফের পুরান ঢাকার নাজিরা বাজারের বাসায় অবস্থান নেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিব ও তার পরিবার। বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মোহাম্মদ হানিফকে খুব স্নেহ ও বিশ্বাস করতেন।
এরপর ১৯৬৫ সালে বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব হন তিনি। বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব হিসেবে ছয় দফা আন্দোলনের প্রস্তুতি, ছয় দফা মুক্তির সনদ প্রণয়ন ও প্রচারে বিশেষ ভূমিকা রাখেন তিমি। ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর জাতীয় নির্বাচন, একাত্তরে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সব আন্দোলনে তিনি রাজপথে প্রথম কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
১৯৭৬ সালে মোহাম্মদ হানিফ ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত স্বপদে বহাল ছিলেন। তিনি টানা ৩০ বছর এ দায়িত্ব পালন করেছেন। ৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী গণঅভ্যুত্থানেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন মোহাম্মদ হানিফ। ১৯৯৬-এর মার্চের শেষ সপ্তাহের গণআন্দোলনে মোহাম্মদ হানিফ তার নেতৃত্বে ‘জনতার মঞ্চ’ গঠন করেন যা তৎকালীন বিএনপি সরকারের পতনসহ আওয়ামী লীগের রাজনীতির জন্য টার্নিং পয়েন্ট তৈরি করে।
২০০৪ সালের ভয়াল ২১শে আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশের ট্রাক মঞ্চে শেখ হাসিনার ওপর নারকীয় গ্রেনেড হামলার সময় নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে মানবঢাল রচনা করে তার প্রিয় নেত্রী বর্তমানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রক্ষার প্রাণান্ত চেষ্টা করেন মোহাম্মদ হানিফ। একের পর এক ছোঁড়া গ্রেনেডের সামনে নির্ভয়ে পেতে দিলেন নিজেকে, শেখ হাসিনা প্রাণে রক্ষা পেলেও উক্ত হামলায় মারাত্মক আহত হন তিনি। মস্তিষ্কসহ দেহের বিভিন্ন অংশে অসংখ্য ঘাতক স্প্লিন্টার ঢুকে পড়ে। দীর্ঘদিনের চিকিৎসাতেও কোন সুফল হয়নি বরং মাথার গভীরে বিধে থাকায় অস্ত্রোপচার করেও অপসারণ করা সম্ভব হয়নি।
২০০৬-এর ৮ই ফেব্রুয়ারী মুক্তাঙ্গনে এক সমাবেশে সভাপতির বক্তৃতা দেয়ার সময় তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। আগে মাথায় বিদ্ধ হওয়া স্প্লিন্টারের প্রতিক্রিয়ায় পরবর্তী সময়ে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। তীব্র যন্ত্রণা ভোগ করে দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে একই বছরের ২৮ই নভেম্বর দিবাগত রাতে ৬২ বছর বয়সে ঢাকার এ্যাপোলো হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।