সাগর পাড়ের জেলা পটুয়াখালীতে বহুমুখি উন্নয়নকে ঘিরে দক্ষিণাঞ্চলের কোটি মানুষের চোখে এখন সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের হাতছানি। পায়রা সমুদ্র বন্দর, তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, বীজ বর্ধন খামার, জাহাজ নির্মানও ভাঙ্গা শিল্প, মেডিকেল কলেজ, সেনা ক্যান্টন্টমেন্ট, নৌ বাহিনীর প্রধান ঘাঁটি, পর্যটন টাওয়ারসহ নানাবিধ উন্নয়ন কার্যক্রম জানান দিচ্ছে দক্ষিনাঞ্চলের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বিপুল সম্ভাবনার। এসব উন্নয়ন প্রকল্পকে ঘিরে অবহেলিত দক্ষিণাঞ্চলের কোটি মানুষ দেখছে সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের সোনালী স্বপ্ন।
সাগরপাড়ের অবহেলিত পটুয়াখালী জেলার মানুষ অভাব-অনটন আর ঝড় ঝঞ্জাসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে আছে। স্বাধীনতার পর এ অঞ্চলে অর্থনীতির গতি সঞ্চার করে কর্মমুখী এমন বড় ধরণের কোন উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া শুরু হয়েছে ২০০৮ সালের পর থেকে। তবে ১৯৯৬ পরবর্তী সরকারের আমলে এ অঞ্চলে প্রথম উন্নয়নের ছোঁয়া লাগতে শুরু করে।
১৯৯৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুয়াকাটাকে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার ঘোষণা দেন এবং উদ্বোধন করেন একাধিক উন্নয়ন প্রকল্পের। এরপরই কুয়াকাটায় গড়ে ওঠে পর্যটন ভিত্তিক মানসম্পন্ন বিভিন্ন স্থাপনা। ২০০৮ সালে দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নে নতুন করে একগুচ্ছ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয় সরকার। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, দেশের তৃতীয় সমুদ্র বন্দর স্থাপনা।
পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার টিয়াখালী ইউনিয়নে ১৬ এর জমির ওপর প্রাথমিকভাবে ২০১৩ সালের ১৯ নভেম্বর পায়রা বন্দরের নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে টিয়াখালী ও একই উপজেলার রাবনাবাদ চ্যানেল সংলগ্ন লালুয়া ইউনিয়নে আরও ৩২ একর জমি অধিগ্রহণ করে শুরু হয় পায়রা পূর্ণাঙ্গ বন্দরের বাস্তবায়নের কর্মযজ্ঞ। এরপর ২০১৬ সাল থেকে সীমিত পরিসরে বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১৯ সালে মাদার ভেসেল থেকে শুরু হয় ব্যয় নিয়মিত পণ্য খালাস। এ পর্যন্ত ১১২টি মাদার ভেসেল পণ্য খালাস করেছে পায়রা বন্দরে। এতে সরকারের আয় হয়েছে ২৬৪ কোটি টাকা। জানা গেছে, পায়রা বন্দর বাস্তবায়নে জমি অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের জন্য রাবনাবাদ চ্যানেল সংলগ্ন লালুয়া এলাকায় পুনর্বাসনের জন্য আবাসন নির্মাণ করা হচ্ছে।
রামনাবাদ চ্যানেলের অপর পাড়ে পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার মৌডুবী সংলগ্ন চরজাহাজমারায় স্থাপিত হতে যাচ্ছে শিপব্রেকিং শিল্প। এখানে পুরানো জাহাজ ভাঙা ছাড়াও নতুন জাহাজ নির্মাণের ইয়ার্ড স্থাপনের উদ্যোগ চলছে। চরজাহাজমারার চারদিকে রয়েছে বিস্তির্ণ সাগর। অন্যদিকে রয়েছে প্রচুর খাস জমি। যা সহজেই এ খাতে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের আগ্রহী করে তুলেছে।
কলাপাড়ার মধুপাড়া-চরনিশানবাড়িয়া এলাকায় এক হাজার ২ একর জমিতে নির্মান হয়েছে ১৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র। প্রতিবেশ-পরিবেশ সহনীয় প্রযুক্তিতে নির্মিতব্য এ প্রকল্পটি চালু হয়ে জাতীয় গ্রীডে যোগ হয়েছে। তা দক্ষিণাঞ্চল তথা দেশের বিদ্যুৎ ঘাটতি পূরণে অন্যতম সম্পদে পরিণত হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়াও বিদ্যুৎ চাহিদা পুরনে লক্ষেই উপকূলীয় এলাকায় ৫/৬ টি কয়লাচালিত বিদ্যুৎ স্থাপনা গড়ে তুলছে সরকার।
দশমিনা উপজেলার চরবাঁশবাড়িয়ায় নির্মিত হয়েছে এশিয়ার সর্ববৃহৎ বীজ বর্ধন খামার। ২০১৩ সালের ১৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বীজ বর্ধন খামারের উদ্বোধন করেন। এ খামারে লবণ ও জলবায়ু সহিষ্ণু ধানের বিভিন্ন জাতের বীজ উৎপাদন করে কৃষক পর্যায়ে পৌছে দেয়া হচ্ছে। এ খামারটি পুরোপুরি চালু হলে বৃহত্তর বরিশাল আবার দেশের খাদ্য ভান্ডারে পরিণত হবে, এমন আশাবাদ সংশ্লিষ্টদের।
অবহেলিত পটুয়াখালী তথা দক্ষিণাঞ্চলের কর্মমুখী অর্থনীতির গতি সঞ্চারে আরেকটি বড় প্রকল্প নেয়া হয়েছে ‘অর্থনৈতিক অঞ্চল’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের জন্য এ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পটুয়াখালী শহর সংলগ্ন ঢাকা-কুয়াকাটা মহাসড়কের পাশে মরিচবুনিয়া এলাকায় ওই অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা হবে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু হয়েছে।
এছাড়াও পটুয়াখালীতে মেডিকেল কলেজ ও ক্যাডেট কলেজ স্থাপন প্রকল্প দক্ষিণাঞ্চলের শিক্ষা ক্ষেত্রে বিপুল পরিবর্তন সাধন করবে বলে অভিজ্ঞ মহলের অভিমত। ২০১৫ সালের ১০ জানুয়ারি শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে এই মেডিকেল কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। সেই থেকে ৫০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু হয়েছে পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজের একাডেমিক কার্যক্রম।
পটুয়াখালীর দক্ষিণে সাগরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের নিরাপত্তা বিধানে জেলা সদরে ১০ একর জমিতে স্থাপিত হয়েছে কোষ্টগার্ডের নিজস্ব ঘাঁটি। দেশে কোষ্টগার্ডের এটি নিজস্ব প্রথম ঘাঁটি। এখানে কোষ্টগার্ডের প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা রয়েছে। ২০১৪ সালের ১১ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোষ্টগার্ডের এ ঘাঁটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।
বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীকে আধুনিকায়নের র্দীঘমেয়াদী পরিকল্পনা হিসাবে ”র্ফোসেস গোল ২০৩০” এর অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। পটুয়াখালীর লেবুখালীতে শেখ হাসিনা সেনানিবাস ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারী উদ্ধোধন করেন প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই সেনানিবাস এলাকা ১৫৩২ একর জমির উপরে ১,৬৯৯ কোটি টাকা ব্যায়ে প্রকল্পটি ২০২১ সালের জুন নাগাদ শেষ হয়।
পটুয়াখালীতে দেশের দ্বিতীয় সাবমেরিন ক্যাবল ল্যান্ডিং স্টেশন ২০১৭ সালের (১০ সেপ্টেম্বর) উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সংলগ্ন লতাচাপলী ইউনিয়নের মাইটভাঙ্গা গ্রামে ২০১৩ সালের শেষের দিকে ১০ একর জমির ওপর ৬৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয় বাংলাদেশের দ্বিতীয় সাবমেরিন ক্যাবল ল্যান্ডিং স্টেশনটি। সাগরের নিচ দিয়ে ইউরোপ থেকে সিঙ্গাপুর হয়ে ২৫ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ ক্যাবল লাইন বঙ্গোপসাগরের উপকূলে কুয়াকাটার স্টেশন থেকে মাত্র সাড়ে ৯কিলোমিটার দূরত্বে পৌছে। ২০১৭সালের জানুয়ারি মাসে ল্যান্ডিং স্টেশনের সঙ্গে তা সংযোগস্থাপন করে মার্চ মাসে উদ্বোধন করা হয়।
২০০৬ সালে কক্সবাজারে প্রথম সাবমেরিন ক্যাবল স্টেশন স্থাপন করা হয়। এটি ৩শ” জিবিপিএস ক্ষমতাসম্পন্ন। কুয়াকাটার দ্বিতীয় সাবমেরিন স্টেশনের ধারন ক্ষমতা হলো এক হাজার ৫ শ” জিবিপিএস। কক্সবাজারের চেয়ে এটি ৫গুন বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন। এই সাবমেরিন স্টেশনটি দেশের চাহিদা মিটিয়ে ব্যান্ডউইথ রফতানির পরিকল্পনাও রয়েছে।
পটুয়াখালী অঞ্চলে যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কলাপাড়া-কুয়াকাটা সড়কে শেখ জামাল, শেখ কামাল ও শেখ রাসেল নামের পৃথক তিনটি সেতুর নির্মাণ করে কুয়াকাটার সাথে যোগাযোগ ব্যাবস্থার উন্নয়ন ঘটানো হয়। এর ফলে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের ভির বেরেছে অনেক। এ ছাড়াও লেবুখালী ব্রীজের কাজ শেষে উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পদ্মা সেতুর নিম্নান কাজ শেষ হলে এবং যোগাযোগ শুরু হলে। উপরন্ত‘ বরিশাল থেকে পটুয়াখালি হয়ে কুয়াকাটা সৈকত পর্যন্ত চারলেন বিশিষ্ট সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। ফলে পায়রা বন্দরের সাথে সুগম হবে দেশের অভ্যন্তরীন যোগাযোগ। রেলপথের মাধ্যমে যুক্ত হবে রাজধানী ঢাকা ও অন্যান্য জেলার সাথে যুক্ত থাকবে পায়রা বন্দর। পায়রা থেকে নৌপথে দেশের বিভিন্ন ¯স্থানের নৌযান চলাচলে বর্তমানে দুটি রুট রয়েছে। একটি পটুয়াখালি হয়ে বরিশাল। অন্য ̈টি ভোলার পশ্চিম থেকে শুরু করে কাজল এবং তেঁতুলিয়া নদী হয়ে কালিগঞ্জ। আকাশপথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার লক্ষে ̈ একটি বিমানবন্দর গড়ে উঠবে বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে।
পটুয়াখালী কলাাপাড়ার ৪ আসনের সংসদ সদস্য মো: মহিববুর রহমান বলেন, যোগাযোগ, শিক্ষা, শিল্প-বাণিজ্যসহ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এসব প্রকল্প পটুয়াখালীর উপকূলীয় জনপদ তথা দক্ষিণাঞ্চলকে দেশের অর্থনীতির অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করবে। প্রকল্পগুলো পুরোদমে চালু হলে ঘুচবে বেকারত্ব। বাড়বে শিক্ষার হার। আর শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে দ্রুত। একইভাবে জীবন-জীবিকার সব ক্ষেত্রেই আসবে পরিবর্তন। শিক্ষা, খাদ্য ও অর্থনীতিতে স্বয়ং সম্পূর্র্ন হবে দক্ষিণাঞ্চল তথা গোটা দেশ। এগুলি সবি সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’র জন্য