বৈশ্বিক মহামারীতে বাংলাদেশে আজ শুধু জনস্বাস্থ্য নিয়েই কথা হচ্ছে না, এসময়ে জাতীয় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘ধর্মভিত্তিক মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের রাজনৈতিক অর্থনীতি’। এ বিষয়েই ওয়েবিনার করেছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি।
শনিবার (২৪ এপ্রিল) দুপুরে ঢাকার ইস্কাটনে সমিতির কার্যালয় থেকে ‘ধর্মভিত্তিক মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের রাজনৈতিক অর্থনীতি: শোভন সমাজের অশোভন প্রতিপক্ষ’ শিরোনামে এ ওয়েব সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।
এতে আলোচক হিসেবে অংশ নেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু এবং সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও প্রগতিশীল ছাত্র জোটের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আল কাদেরী জয়। সভা সঞ্চালনা করেন অর্থনীতি সমিতির সহ সম্পাদক শেখ আলী আহমেদ টুটুল।
গণমানুষের অর্থনীতিবিদ হিসেবে খ্যাত অধ্যাপক আবুল বারকাতের সদ্য প্রকাশিত ‘বড় পর্দায় সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র: ভাইরাসের মহাবিপর্যয় থেকে শোভন বাংলাদেশের সন্ধানে’ গবেষণাগ্রন্থটির বিষয়বস্তু ঘিরে ১৩ সিরিজের আলোচনা সভার এ সপ্তম পর্বটি অনুষ্ঠিত হয়।
ওয়েবিনারে হাসানুল হক ইনু বলেন, “অধ্যাপক বারকাতের এই বই অনেক তথ্যসমৃদ্ধ, তার উপস্থাপিত তথ্য ও ব্যাখ্যা আমি সমর্থন করি। তিনি ঠিকই বলেছেন যে ধর্মের ভুল ব্যাখ্যায় মানুষ ধর্মান্ধ হয়ে পড়ে…রাজনীতির মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে মৌলবাদ ব্যবহৃত হয়।”
অধ্যাপক আবুল বারকাতের বই থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে ইনু বলেন, “৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দেশ বিনির্মাণ উল্টোপথে হাঁটা শুরু করে।…বর্তমানে মূলধারার রাজনীতি ও শিক্ষাব্যবস্থায় মৌলবাদীদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে।…রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে মৌলবাদীদের ঔদ্ধত্যে একটা হুমকির মুখে আমরা পড়ে গেছি।…করোনাভাইরাস মহামারীতে হতাশাকে কেন্দ্র করে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করতে পারে মৌলবাদীরা।”
ইনু বলেন, “সংবিধানের চার নীতি যারা মানে না তাদের রাজনীতি করার অধিকার নেই। ফুলের বাগানে শুকরকে ঢুকতে দিলে ফুলের বাগান তছনছ করে দেবে। তেমনই গণতন্ত্রে জঙ্গিবাদী মৌলবাদীদের আশ্রয় দিলে সব তছনচ হয়ে যাবে। এখানে মাঝামাঝি কোন তত্ত্ব নেই, একাত্তরে যেমন পাকিস্তানিদের আমরা পরাজিত করেছি, তেমনি এখন জঙ্গি ও মৌলবাদীদের তাড়াতে হবে।”
“অধ্যাপক বারকাতের প্রস্তাবিত ‘শোভন সমাজ’ এর যাত্রা শুরু হতে পারে একটি সমান্তরাল লড়াইয়ের মাধ্যমে। বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই ও মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে হবে।” আওয়ামী লীগের ভেতরে ধর্মব্যবসায়ী ও মৌলবাদীদের প্রবেশ ঘটেছে অভিযোগ করে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, “পৃথিবীর কোথাও বড় কোন বিপ্লবের পর প্রতিবিপ্লবীদের রক্ষা করা হয়নি, কারণ প্রতিবিপ্লবীরা সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন। কিন্তু বাংলাদেশে সেটা হয়নি। মৌলবাদীদের উত্থানের বড় কারণ হলো আর্থিক সাহায্য। এটা শুরু করেছিলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান, এখনও বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের আর্থিক সহায়তা আসে পাকিস্তান ও তার দোসরদের কাছ থেকে।”
আল কাদেরী জয় বলেন, “মৌলবাদী শক্তি ও পুঁজিবাদী শক্তি হাত ধরাধরি করে চলছে। অধ্যাপক আবুল বারকাত তার বইয়ে রেন্ট-সিকার, লুটেরা শক্তিকে মৌলবাদীদের পৃষ্ঠপোষক বলেছেন।” তিনি অভিযোগ করে বলেন, “হেফাজত ২০১১ এর নারী নীতিমালার বিরোধিতা করে, সেই হেফাজতের সঙ্গে আমাদের শাসকগোষ্ঠী অতীতের শাসকগোষ্ঠীর মতো সম্পর্ক বজায় রেখেছে, হেফাজতের দাবি মেনে পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন এনেছে, হাই কোর্টের সামনে গ্রিক থেমিসের ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলা হয়েছে, দাওরায়ে হাদিসের সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রির সমমান দেওয়া হয়েছে। কৃষক-শ্রমিক-ছাত্রদের তাদের অধিকার থেকে দূরে সরিয়ে সাম্প্রদায়িকতা ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে।” জয় বলেন, “অধ্যাপক আবুল বারকাত যে শোভন সমাজের কথা বলেছেন তাকে আমরা আমাদের প্রত্যাশার জায়গা থেকে দেখি, আর তা পূরণের সামাজিক ভিত্তি উপাদান হতে পারে মৌলবাদী শক্তিকে মোকাবেলা করা, শোষণমুক্তির লড়াই করা।”
শেখ আলী আহমেদ টুটুল জানান, আগামী ৮ মে বাংলাদেশ সময় দুপুর ২টায় ‘বিশ্বায়ন প্রসঙ্গে: শোভন সমাজের সন্ধানে’ শীর্ষক অর্থনীতি সমিতির অষ্টম ওয়েবইনার অনুষ্ঠিত হবে। এতে আলোচক হিসেবে থাকবেন- সেন্টার ফর পলেসি ডায়লগ (সিপিডি) এর ডিসটিংগুইস ফেলো প্রফেসর ড. মোস্তাফিজুর রহমান, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) এর সাধারণ সম্পাদক কমরেড খালেকুজ্জামান এবং বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সহ সভাপতি সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. আব্দুল হান্নান। ওয়েবিনারটির সঞ্চালকের দায়িত্বে থাকবেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির যুগ্ম সম্পাদক ড. মো. লিয়াকত হোসেন মোড়ল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও প্রাক্তন চেয়ারম্যান এবং জাপানিজ স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান আবুল বারকাতের ২০ বছরের গবেষণার ফসল ‘বড় পর্দায় সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র: ভাইরাসের মহাবিপর্যয় থেকে শোভন বাংলাদেশের সন্ধানে’ বইটি যৌথভাবে প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি ও মুক্তবুদ্ধি প্রকাশনা। ৭১৬ পৃষ্ঠার এ বইটি সম্পর্কে অভিনন্দনবাণী দিয়েছেন ভাষাবিজ্ঞানী, দার্শনিক ও সমাজ সমালোচক অধ্যাপক নোয়াম চমস্কি। কৃতজ্ঞতাপত্র, মুখবন্ধ ও মোট ১২টি অধ্যায় ছাড়াও বইটিতে আছে ২৭টি সারণি, ৩৯টি লেখচিত্র, তথ্যপঞ্জি ও নির্ঘণ্ট।
বড় দাগে ১২টি অধ্যায়ে আছে- শোভন সমাজের তত্ত্ব-কাঠামো, প্রচলিত মূলধারার অর্থনীতি শাস্ত্রের অপরাগতা ও নতুন অর্থনীতি শাস্ত্রের যৌক্তিকতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রাজনৈতিক অর্থনীতি: শোভন জীবন ব্যবস্থার ভিত্তি, ধনী-দরিদ্র- শ্রেণীবৈষম্য ও অসমতা: শোভন সমাজ বিনির্মাণে প্রধান দুর্ভাবনার বিষয়, ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ: শোভন সমাজের অশোভন প্রতিপক্ষ, বিশ্বায়নের স্বরূপ, দুর্নীতি দুর্বৃত্তায়নের কাঠামোতে ‘অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি’ কেন হচ্ছে কতদূর হবে, কোভিড-১৯ এ ক্ষতির বিশ্লেষণ এবং মোকাবিলার ভাবনা, শোভন সমাজ-অর্থনীতি বিনির্মাণের প্রস্তাবিত মডেল, সমাজ সমগ্রকের রাজনৈতিক অর্থনীতি এবং কেমন হওয়া উচিত শোভন সমাজ বিনির্মাণের জাতীয় বাজেট?