কাগজে-কলমে খেলাপি ঋণ কম দেখাতে করোনার বছরে বিপুল অঙ্কের ঋণ অবলোপন করেছে সরকারি-বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অবলোপন বেসরকারি ব্যাংকের। এটা নতুন রেকর্ড।
আগে অবলোপন বেশি হতো সরকারি ব্যাংকে। ২০২০ সালে অবলোপনের মাধ্যমে ৬ হাজার ৫৯০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ ব্যাংকের ব্যালান্স শিট বা স্থিতিপত্র থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। যা ২০১৯ সালে ছিল ২ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে ঋণ অবলোপন বেড়েছে প্রায় আড়াই গুণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে উঠে আসে এসব তথ্য।
ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত অবলোপন করা ঋণের স্থিতি ৪৪ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা। আর ওই সময় পর্যন্ত ব্যাংকের স্থিতিপত্রে থাকা খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৮৮ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা। অবলোপন করা ঋণ যোগ করলে খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৩২ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকা।
আদায় না করেই ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কমাতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা ছাড় দিয়ে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। করোনার কারণে গত বছর কেউ ঋণ ফেরত না দিলেও খেলাপি না করার সিদ্ধান্তের আগে ২০১৯ সালে মাত্র ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্টে ৫২ হাজার ৭৬৭ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। এর আগে কোনো গ্রাহকের ৫০০ কোটি টাকার বেশি অঙ্কের ঋণ বিশেষ সুবিধায় পুনর্গঠনের সুযোগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও বিআইবিএমের প্রাক্তন মহাপরিচালক ড. মইনুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, করোনায় গত বছর থেকে কাউকে খেলাপি করা হচ্ছে না। সুতরাং ঋণ অবলোপনের উল্লিখিত পরিসংখ্যান সঠিক নয়, এ অঙ্ক বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। প্রকৃত অবলোপন আরও বেশি হবে।
তিনি বলেন, খেলাপিঋণ ঢেকে রাখার অনেক মাধ্যমের একটি ঋণ অবলোপন। এর মাধ্যমে খেলাপির প্রকৃত তথ্য গোপন করা হয়। খেলাপি ঋণ আদায়ে সরকারের কোনো রাজনৈতিক সদিচ্ছা নেই বলে মনে করেন তিনি। তার মতে, নতুন করে খেলাপি ঋণ আদায়ে যেসব উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে, এটা ‘আই ওয়াশ’। জনগণের সঙ্গে প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালার আলোকে ২০০৩ সাল থেকে ব্যাংকগুলো ঋণ অবলোপন করে আসছে। ব্যাংক ব্যবস্থায় মন্দ মানে শ্রেণিকৃত খেলাপি ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রেখে স্থিতিপত্র থেকে বাদ দেয়াকে ঋণ অবলোপন বলে। ঋণগ্রহীতা পুরো টাকা পরিশোধ না করা পর্যন্ত খেলাপি হিসাবে বিবেচিত হন। তবে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হিসাবে তা দেখানো হয় না।
বর্তমানে কোনো মামলা ছাড়া ব্যাংকগুলো দুই লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ অবলোপন করতে পারে। যেসব ঋণ নিকট ভবিষ্যতে আদায়ের সম্ভাবনা নেই এবং মন্দমানে খেলাপি হওয়ার অন্তত ৩ বছর পার হয়েছে ব্যাংকগুলো শুধু তা অবলোপন করতে পারে। অবলোপন করে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর প্রক্রিয়া নিয়ে সমালোচনা রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে অবলোপন করা ঋণের বেশিরভাগই ছিল বেসরকারি ব্যাংকের। গত বছর বেসরকারি ব্যাংকগুলো পাঁচ হাজার ১৮৬ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপন করে। ব্যাংক খাতে মোট অবলোপনের যা ৭৮ দশমিক ৬৯ শতাংশ। সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো অবলোপন করেছে এক হাজার ৩৭০ কোটি টাকা বা মোটের ২০ দশমিক ৭৮ শতাংশ। বাকি ৩৩ কোটি টাকা অবলোপন হয়েছে বিদেশি ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো।
অবলোপন ব্যাপক বাড়লেও এ থেকে ঋণ আদায় কমেছে। ২০১৯ সালে যেখানে অবলোপন করা ঋণ থেকে ৮৩১ কোটি টাকা আদায় হয়। গত বছর তা ৭৪৬ কোটি টাকায় নেমেছে। এক সময় শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে ব্যাপক ঋণ অবলোপনের সংস্কৃতি ছিল। খেলাপি ঋণ কম দেখানোর সহজ উপায় হিসেবে এখন বেসরকারি ব্যাংকগুলোও এ পথে হাঁটছে বলে মনে করেন অনেকে।
এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আতাউর রহমান প্রধান যুগান্তরকে বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো অবলোপন থেকে সরে এসে ঋণ আদায়ে জোর দিচ্ছে। সে কারণে সরকারি ব্যাংকে ঋণ অবলোপন কম হয়েছে। আর যে সব বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেশি, সেসব ব্যাংক ব্যালেন্সশিট পরিষ্কার রাখতে অবলোপনের পথে হাঁটছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ডিসেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে অবলোপন করা হয়েছে ১৭ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকা। বিশেষায়িত ব্যাংকে এক হাজার ৩৬ কোটি টাকা। বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে স্থিতি ২৫ হাজার ২৫৯ কোটি টাকা। আর বিদেশি ব্যাংকে ৩৭৫ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, অনেক ব্যাংক আর্থিক প্রতিবেদন পরিষ্কার রাখতে খেলাপি ঋণ কমানোর সহজ পন্থা হিসাবে অবলোপনকে বেছে নিয়েছে। খেলাপি ঋণ আদায় জোরদারের চেয়ে তারা মনোযোগ দিচ্ছে অবলোপনের দিকে, যা কোনো উত্তম সমাধান নয়। অবলোপন প্রক্রিয়াকে আরও কঠোর করার চিন্তাভাবনা চলছে বলে জানান তারা।