মহামারীতে বিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে প্রয়াস চালাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অর্থনীতির প্রতিটি খাতে করোনার অভিঘাত নিয়ে গবেষণা চালিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব ও আগামী কয়েক বছরে সম্ভাব্য গতিপ্রকৃতি নিয়ে করেছে তাদের প্রক্ষেপণ। ঊর্ধ্বমুখী খেলাপি ঋণ, মূলধন ও সঞ্চিতি ঘাটতিসহ বিভিন্নমুখী সংকটের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছিল দেশের ব্যাংক খাত। এর মধ্যেই বিশ্বব্যাপী শুরু হয় কভিড-১৯-এর সংক্রমণ। মহামারীর প্রাদুর্ভাবে বিশ্বের অন্যান্য স্থানের মতো দেশের অর্থনীতিতেও স্থবিরতা নেমে আসে। এর ধারাবাহিকতায় দেশের ব্যাংক খাতের দুর্যোগ মোকাবেলার সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। তবে করোনা সংক্রমণের এক বছর পর দেখা যাচ্ছে, অর্থনৈতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় যথেষ্ট সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে দেশের ব্যাংক খাত। সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের এক-তৃতীয়াংশই বাস্তবায়ন হচ্ছে খাতটির মাধ্যমে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও বলছে, ব্যাংক খাত এখন পর্যন্ত কভিডের ধাক্কা মোকাবেলায় সক্ষমতা দেখিয়েছে। নিকট ভবিষ্যতেও খাতটিতে বড় ধরনের কোনো সংকট দেখা দেয়ার আশঙ্কা নেই। মহামারীকালীন এক বছরের আমানত ও ঋণের প্রবৃদ্ধি, মূলধনের অনুপাত, সম্পদের গুণগত মান, সম্পদের বিপরীতে আয়সহ ব্যাংক খাতের মৌলিক সূচকগুলোর বিশ্লেষণের ভিত্তিতে এমন পর্যবেক্ষণ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। করোনাকালে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের দায়িত্ব বর্তেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর। ব্যাংক খাতের মহামারীকালীন কার্যক্রম নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ বলছে, খাতটি এখন পর্যন্ত করোনার ধাক্কা মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছে। ব্যাংক খাতের স্থিতিস্থাপকতা চলতি বছরের বাকি সময়েও অব্যাহত থাকবে। বছরজুড়ে ব্যাংক খাতে আমানত ও ঋণের প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক ধারায় থাকবে। প্রবৃদ্ধি হবে মূলধন পর্যাপ্ততার হারেও (সিআরএআর)। নিয়ন্ত্রিত থাকবে খেলাপি ঋণ, বাড়বে ব্যাংকগুলোর আয় ও মুনাফা। রিস্থিতি অনুকূল থাকলে কোন সূচকে কী পরিবর্তন হবে, সে বিষয়েও প্রক্ষেপণ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এক্ষেত্রে চলতি বছর শেষে দেশের ব্যাংক খাতের সিআরএআর ১২ দশমিক ৮ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে বলে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। এতে আরো বলা হয়েছে, চলতি বছর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের হার হবে সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ১ শতাংশ। সম্পদের বিপরীতে আয় (আরওএ) বেড়ে ১ দশমিক ৬ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। ব্যাংক খাতের আমানত ও ঋণ অনুপাত (এডিআর) হতে পারে ৮৬ দশমিক ৪ শতাংশ। অর্থনীতির অন্যান্য সূচক ইতিবাচক ধারায় ফিরে আসায় ব্যাংকগুলোর ঋণ আদায় বাড়বে। দেশের ব্যাংক খাতের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও পূর্বাভাস নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু ফরাহ মো. নাছের। তিনি বলেন, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছিল। করোনার প্রথম ঢেউ কাটিয়ে চলতি বছরের শুরুতে সবকিছু স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফিরে এসেছিল। আমাদের পর্যবেক্ষণটি ওই সময়ের ভিত্তিতে করা। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হানায় এপ্রিল থেকে এখনো সীমিত পরিসরে লকডাউন চলছে। এরই মধ্যে দ্বিতীয় আঘাতও আমরা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। এখন ভারতীয় ধরন ছড়িয়ে পড়লে বা তৃতীয় ঢেউ এলে সব পূর্বাভাসই পাল্টে যেতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি যা, তাতে ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতারই আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
দেশের ব্যাংক খাতের সক্ষমতা নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা ছিল। কিন্তু করোনাকালীন অর্থনীতি টিকিয়ে রাখা ও পুনরুদ্ধারে ব্যাংক খাতই সবচেয়ে বেশি কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। সরকার ঘোষিত ১ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা প্যাকেজের মধ্যে ৯০ হাজার কোটি টাকাই ব্যাংক খাত থেকে জোগান দেয়া হয়েছে। এটি ব্যাংক খাতের সক্ষমতারই বহিঃপ্রকাশ।
ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতার পূর্বাভাস দিতে দেশের করোনাপূর্ব ও পরবর্তী অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং ব্যাংকগুলোর পরিসংখ্যান বিবেচনায় নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সার্বিক পর্যালোচনা শেষে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের ব্যাংক খাতের স্থিতিস্থাপকতা নিয়ে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, মহামারী সত্ত্বেও ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের ব্যাংক খাতের ঋণ, বিনিয়োগ ও আমানতের প্রবৃদ্ধি পরিমিত ছিল। ফলে এ সময়ে ব্যাংকগুলোর মূলধন পর্যাপ্ততা, সম্পদের গুণগত মান, সম্পদের বিপরীতে আয়সহ (আরওএ) অন্যান্য সূচক ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফিরতে শুরু করায় আগামীতে ব্যাংক খাতের মুনাফা বাড়বে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রক্ষেপণ হলো, চলতি ২০২১ সাল শেষে ব্যাংক খাতের সিআরএআর ১১ দশমিক ৫ শতাংশে স্থিতিশীল থাকবে। প্রয়োজনের চেয়েও অনেক বেশি থাকবে বেসরকারি ও বিদেশী খাতের ব্যাংকগুলোর সিআরএআর ও ক্যাপিটাল কনজারভেশন বাফার (সিসিবি)। তবে লোকসান ও খেলাপি ঋণের কারণে মূলধনের মৌলিক এ দুটি সূচক আরো নেতিবাচক অবস্থার দিকে যাবে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর।
২০২০ সালজুড়ে ঋণগ্রহীতাদের কিস্তি পরিশোধে নীতি ছাড় দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি বছরের শুরু থেকে আবারো ঋণ পরিশোধে বাধ্যবাধকতা ফিরে এসেছে। এ অবস্থায় ঋণ আদায় না বাড়ালে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাবে বলে শঙ্কার কথাও জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, শঙ্কা সত্ত্বেও ২০২১ সালে দেশের ব্যাংকগুলোর মুনাফা ও সম্পদের বিপরীতে আয় ইতিবাচক থাকবে। একইভাবে ইতিবাচক ধারায় থাকবে দেশের ব্যাংক খাতের তারল্য পরিস্থিতিও। সব মিলিয়ে বিপর্যস্ত বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতেও চলতি বছর বাংলাদেশের ব্যাংক খাত যথেষ্ট স্থিতিশীল থাকার পূর্বাভাস দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে এর মধ্যেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো নিয়ে উদ্বেগের কথা তুলে ধরেছে তারা। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ হলো, রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর ঋণ ব্যবস্থাপনা ও আদায় পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি হচ্ছে না। ‘ইকোনমিক অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি ইমপ্লিকেশনস অব কভিড-১৯: বাংলাদেশ ব্যাংক অ্যান্ড গভর্নমেন্টস পলিসি রেসপন্স’ শীর্ষক বিশেষ প্রতিবেদনে এ পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বাভাসের সঙ্গে দ্বিমতও আছে অনেক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীর। এ বিষয়ে সরকারি-বেসরকারি একাধিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিজেদের মতামত জানালেও তাদের কেউ নাম উদ্ধৃত করে বক্তব্য দিতে চাননি। তারা বলছেন, নীতি শিথিলতার কারণে আপাতত দেশের ব্যাংক খাতের চিত্র ভালো দেখা যাচ্ছে। শিথিলতার মেয়াদ শেষে ঋণ শ্রেণীকরণ ও অন্যান্য বাধ্যবাধকতা যখন পরিপালন শুরু হবে, তখন ব্যাংক খাতের প্রকৃত রূপ বেরিয়ে আসবে। গার্মেন্টস, ওষুধ, সিমেন্ট, রডসহ কিছু ভারী শিল্পের পরিস্থিতি ভালো। কিন্তু সেবা খাতের বৃহৎ অংশসহ বেশির ভাগ এসএমই প্রতিষ্ঠানের অবস্থা খুবই নাজুক। অনেক প্রতিষ্ঠান ব্যাংকঋণ পরিশোধের পরিস্থিতিতে নেই। অনেক এসএমই প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। মূলধনি যন্ত্রপাতিসহ বিভিন্ন খাতের আমদানি কমে গেছে। দেশে নতুন কোনো বিনিয়োগ হচ্ছে না। এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্বাভাস বাস্তবে কতটুকু ধরা দেবে, সেটি সময়ই বলে দেবে।
দেশের ব্যাংক খাতকে আগামীতে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সামনে এগোতে হবে বলে মনে করেন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এ শীর্ষ নির্বাহী বলেন, গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানগুলো বেঁচে থাকলে আগামীতে ভালো ব্যবসা করতে পারবে। কারণ বিশ্বব্যাপী মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় মানুষ কম দামের পোশাক কিনবে। আমাদের দেশের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই কম মূল্যের পোশাক তৈরি করে। তবে সমস্যা হবে এসএমইসহ সেবা খাতের অনেক প্রতিষ্ঠান নিয়ে। ব্যাংকগুলোর মোট বিনিয়োগের ২৫ শতাংশ এসএমই খাতে। ব্র্যাকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় আমরা দেখছি, দেশের আড়াই কোটি মানুষ করোনাকালে নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। এ অবস্থায় অভ্যন্তরীণ ভোগ বাড়ানো হবে বড় চ্যালেঞ্জ।