রাজধানীতে ফ্ল্যাট কেনার জন্য সজিব হাসানকে (৩৪) গ্রামের বাড়িতে জমি বিক্রি করতে চাপ দিচ্ছিলেন তাঁর তথাকথিত স্ত্রী শাহনাজ পারভীন (৪৭)। নানা অজুহাতে সজিব সেটি করেননি। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে শাহনাজ তাঁকে নৃশংসভাবে হত্যা করেন। রাজধানীর ওয়ারীর কে এম দাস রোডের বাসা থেকে সজিবের পাঁচ খণ্ড লাশ উদ্ধারের পর এমনটাই দাবি করেছেন সজিবের মা সূর্য নেছা (৫০)।
শাহনাজ নাম পাল্টিয়ে সাদিয়া ইসলাম মৌ নামে পরিচয় দিতেন বলে জানিয়েছেন সূর্য নেছা। তাঁর ভাষ্য, নিজেকে গোয়েন্দা কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দিতেন শাহনাজ। সজিবের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার আগে ওই নারীর দুইজনের সঙ্গে বিয়েবিচ্ছেদ হয়।
নিহত সজিবের পরিবার ও এলাকাবাসী জানায়, প্রায় ১১ বছর আগে সজিব-শাহনাজ স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে নিহতের গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডের তাহেরহুদা ইউনিয়নের নারায়ণকান্দি যান। পরিবার প্রথমে মেনে নিতে না চাইলে একসময় মেনে নেয়। কখনো পরিবারের সদস্যরা ঢাকায় আসতে চাইলে সজিব তাঁদের আনতেন না, ঠিকানাও দিতেন না। লাশ উদ্ধারের দিন সকালেও সূর্য নেছাকে মোটর সারানোর জন্য বিকাশে এক হাজার টাকা পাঠান শাহনাজ। এ সময় সজিবের তথাকথিত স্ত্রী শাহনাজ জানান, তাঁরা রাতের ফ্লাইটে লন্ডন চলে যাবেন। এ সময় সজিবকে ফোনে চাইলে শাহনাজ জানান টিকিটের কাজে তিনি বাইরে আছেন।
গতকাল সজিবের মা সূর্য নেছা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বউ হিসেবে ১১ বছর ধরে আমার বাড়ি আসা-যাওয়া করে। যখন প্রথম আসে তখন আমরা জানতে পারি, যে সনে ওই মেয়ে মেট্রিক পাস করে সেই সনে আমার বেটার জন্ম। আমার মেজো বোনের বাসায়ও বউ নিয়ে বেড়াইছে। ওই মেয়ে জানায়, তাদের গ্রামের বাড়ি যশোরের সোনাপুর। ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে বাসা। তারা ছয় ভাই-বোন। বড় ভাই ব্যাংকে চাকরি করে। ছোট ভাই-বোনেরা কানাডায় থাকে।’
নারায়ণকান্দি ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার আনিছ মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ওই মেয়েকে আমরা বেশ কয়েকবার সজিবের বাড়ি আসতে দেখেছি। আমরা এলাকাবাসী সবাই জানি তারা স্বামী-স্ত্রী। সে হিসেবে আসা-যাওয়া করে। হত্যাকাণ্ডের পরে নানা ধরনের চাঞ্চল্যকর তথ্য শুনতে পাচ্ছি। পরে খোঁজ করে তাদের বাড়িতে বিয়ের কোনো ডকুমেন্ট পাইনি। সজিবকে এলাকায় খুবই শান্তশিষ্ট ছেলে হিসেবে আমরা জানতাম।’
টিপু সুলতান মাস্টার নামে নারায়ণকান্দির বাসিন্দা বলেন, ‘সজিব ও মৌ (শাহনাজ) ঢাকা থেকে এলে আমার বাড়ির পাশ দিয়েই তাদের বাড়িতে যাইত। তাদেরকে আমরা ১০-১২ বছর ধরে স্বামী-স্ত্রী হিসেবেই জানি। এলাকায় এসে প্রতিবার সপ্তাহখানেক থাকত। এখন হঠাৎ করে ঘটনার পর থেকে ওই মেয়ের চাঞ্চল্যকর তথ্য পাচ্ছি।’
হরিণাকুণ্ডের ওসি আব্দুর রহিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঘটনাটি যদিও ঢাকায় হয়েছে, তা-ও বিভিন্ন মাধ্যমে নিহত সজিবের আত্মীয়-স্বজনের মাধ্যমে জানতে পেরেছি তাঁরা স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে কয়েববার বাড়িতে এসেছেন।’
অবশ্য ঘটনার পরদিন গত শুক্রবার শাহনাজ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তাতে সজিবের সঙ্গে বিয়ে নয়, প্রেমের সম্পর্ক ছিল বলে দাবি করেন শাহনাজ। তাঁর ভাষ্য, ১১ বছর ধরে তাঁদের পরিচয়। সজিব তাঁর সঙ্গে মিথ্যা পরিচয়ে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তার পরও তাঁদের সম্পর্ক চলছিল। সজিবের বাসাভাড়াও শাহনাজ বহন করছিলেন। এক পর্যায়ে সজিবের ফুফুর বাড়ি গাজীপুর থেকে ২০ লাখ টাকা এনে তাঁদের ব্যবসা করার কথা থাকলেও সজিব আনতে ব্যর্থ হন। বুটিকসের কাজের কথা পরিবারকে বলে সজিবের বাসায় সময় কাটাতেন শাহনাজ। সজিবও তাঁর বাসায় নিয়মিত আসা-যাওয়া করতেন। একসময় তাঁর কলেজপড়ুয়া মেয়ের সঙ্গেও সজিবের সম্পর্ক হয়ে যায়। এ বিষয়ে শাহনাজ তাঁকে সতর্ক করলেও পাত্তা দেননি। পরে মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কের ভিডিও দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করা শুরু করলেই শাহনাজ তাঁকে খুন করার পরিকল্পনা করেন। এ জন্য গত ৮ ফেব্রুয়ারি তিনি সজিবের বাসায় এসে ওঠেন। গত বৃহস্পতিবার এসব ঘটনা নিয়ে তর্কবিতর্কের এক পর্যায়ে সজিব তাঁকে ছুরি দিয়ে আঘাত করলে শাহনাজ তা ঠেকিয়ে তাঁকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন। পরে সজিবের হাত থেকে ছুরি নিয়ে তাঁর পেটে ঢুকিয়ে দেন। পরে উপর্যুপরি আঘাত করে তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত করে রান্নাঘর থেকে বঁটি এনে লাশ পাঁচ টুকরো করেন। শাহনাজের দুই ছেলে চাকরি করেন এবং স্বামী ব্যবসা করেন। তাঁরাও ওয়ারীর একই এলাকায় থাকেন।