এম রাসেল সরকার, বিশেষ প্রতিনিধি: বিভিন্ন সরকারি অফিস, সাংবাদিক বা বিভিন্ন স্পর্শকাতর পেশার পরিচিতি সম্বলিত ভুয়া স্টিকার গাড়িতে ব্যবহার করে অপরাধের মাত্রা বাড়ছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) এই ভুয়া এবং অবৈধ স্টিকার লাগানো গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে।
তবে অভিযান চালাতে গিয়ে পুলিশ দেখতে পেয়েছে বৈধ স্টিকার ব্যবহারের কোনো নীতিমালা নেই সরকারি বেসরকারি কোনো পর্যায়েই। ফলে কে কোন পর্যায়ে, কী প্রয়োজনে এবং কী ধরনের গাড়িতে পেশা বা প্রতিষ্ঠানের পরিচিতিমূলক স্টিকার লাগাতে পারবেন তা নিয়েও আছে বিভ্রান্তি।
অবশ্য সবচেয়ে উদ্বেগের কথা হলো পুলিশ, সাংবাদিক এমন কী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্টিকার গাড়িতে ব্যবহার করে মাদক চোরচালানসহ নানা অপরাধ হচ্ছে। এ বিষয়ে ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, “পুলিশের স্টিকার গাড়িতে ব্যববহার করে নানা ধরনের অপরাধের তথ্য আমাদের কাছে আছে।”
আর অপরাধ দমনে নিয়োজিত ব্যক্তিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, অপরাধীরা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে পুলিশ ও সাংবাদিক লেখা স্টিকার। এর বাইরে সরকারি নানা প্রতিষ্ঠান, মন্ত্রণালয়ের স্টিকারও ব্যবহার করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে ওই প্রতিষ্ঠানের কেউ না হয়েও পরিচয় বা আত্মীয়তার সূত্রে প্রতিষ্ঠানের স্টিকার ব্যবহার করা হয়। এমনকি সংসদ সদস্যদের স্টিকারও অন্যদের ব্যবহারের নজির আছে।
ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের যুগ্ম কমিশনার এস এম মেহেদী হাসান জানান, ১২ এপ্রিল অভিযান শুরু করে এ পর্যন্ত অবৈধ স্টিকার ব্যবহারের দায়ে তারা ৩৬৩টি গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। এসব গাড়িতে, পুলিশ, সাংবাদিক, ডাক্তার, আইনজীবীসহ বিভিন্ন সরকারি, আধা সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের স্টিকার ছিলো। তিনি বলেন, ভুয়া স্টিকার ব্যবহার করে অপরাধ বাড়ছে। ভুয়া স্টিকারের কারণে পুলিশের দায়িত্ব পালনেও নানা অসুবিধা হয়। এই কারণেই আমরা অভিযান চালাচ্ছি। আমাদের এই অভিযান চলবে।
ভুয়া স্টিকারের দৌরাত্ম:
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর একটি চোরাচালান চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করে। নাটোরের সিংড়া উপজেলার লালোর বাজার এলাকা থেকে দুইটি গাড়িসহ তিনজনকে আটকের পর তাদের কাছ থেকে ২০০ কেজির বেশি গাঁজা উদ্ধার করা হয়। আর গাড়ি দুটিতে লাগানো ছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্টিকার। ওই অভিযানে নেতৃত্ব দেন রাজশাহী বিভাগীয় মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের গেয়েন্দা বিভাগের উপ পরিচালক মোহা. জিললুর রহমান।
তিনি বলেন, আমরা অভিযানের সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্টিকার ও গাড়ির প্রটোকল, লাইট দেখে কিছুটা ইতস্তত করছিলাম। তারা আমাদের ফাঁকি দিয়ে চলে যাওয়ারও চেষ্টা করে । কিন্তু আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকায় তাদের আটক করে গাঁজা উদ্ধার করতে পারি।
তার কথা, শুধু ২০২৩ সালেই আমরা গোয়েন্দা দপ্তর থেকে ১,৩৫৩ কেজি গাঁজা আটক করেছি। ৪৫০টি মামলার অনেকগুলোতেই অপারাধীরা পুলিশ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সরকারি প্রতিষ্ঠানের স্টিকার ব্যবহার করেছে। মাদক বহনকারী এমন গাড়িও পেয়েছি যাতে যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যবহার করা স্টিকার ছিলো। গাড়িতে ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ডও ছিলো। সাংবাদিক লেখা গাড়িও আমরা পেয়েছি। আমরা সাধারণত সরকারি বা সাংবাদিক লেখা স্টিকার দেখলে সন্দেহ করি না, ছাড় দেই। সেই সুযোগ নেয় অপরাধীরা।
সাংবাদিক, এমনকি সংবাদ মাধ্যমের নাম লেখা স্টিকার গাড়িতে লাগিয়েও মাদক পাচারের অনেক ঘটনা ঘটছে। ঘটছে “পুলিশ” ও “ডিবি” লেখা স্টিকার লাগিয়ে অপরাধ। এসব ঘটনা বেশি ঘটছে মাদক চোরাচালানের রুট বিশেষ করে সীমান্তের জেলাগুলোতে। কক্সবাজার, চট্টগ্রাম এলাকায় টিভি চ্যানেলের স্টিকার লাগিয়ে মাদক চোরাচালানের অনেক ঘটনা গত কয়েক বছরে ধরা পড়েছে। ২০১৯ সালে সীতাকুণ্ড এলাকায় গাড়িতে “গাজী টেলিভিশন” স্টিকার লাগিয়ে ১,৪০০ পিস ইয়াবা পাচারের সময় চার ইয়াবা পাচারকারী আটক হয়।
গত বছরের আগস্টে র্যাব ঢাকার একটি মাদক পাচারকারী চক্রের সদস্যদের আটক করে। তারা পুলিশ, সাংবাদিক, ডিবি ও আইনজীবীর স্টিকার ব্যবহার করে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় মাদক সরবরাহ করত। তাদের কাছ থেকে প্রায় দেড় কোটি টাকার বিদেশি মদও উদ্ধার করা হয়। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে নরসিংদিতে র্যাব একটি চক্রকে আটক করে। তারা সংসদের স্টিকার ব্যবহার করে মাদক চোরাচালান করত। ঢাকার ওয়ারি এলাকা থেকে গত বছর পুলিশ কয়েকজন ছিনতাইকারীকে আটক করে যারা মটরসাইকেলে পুলিশের স্টিকার ব্যবহার করে ছিনতাই করত।
ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের উপ পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, “পুলিশ ও ডিবির শুধু স্টিকার নয়, পোশাক ব্যবহার করেও ছিনতাই অপহরণের মতো ঘটনাও আছে। এরমধ্যে কিছু অপরাধী আছে যারা আগে পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করত। তারা পুলিশের আচার আচরণ ও রীতি নীতি শিখে নিজেরাই পুলিশ হয়ে গেছে। আরেক গ্রুপ আছে অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার করে অপরাধ করে।”
স্টিকারের নিয়ম কী?
গাড়িতে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে স্টিকার ব্যবহারের কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই বলে জানান, ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের যুগ্ম কমিশনার এস এম মেহেদী হাসান। তিনি বলেন, “ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ড ব্যবহারের নীতিমালা আছে। তবে সরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়ির কাগজপত্র যেহেতু গাড়িতে থাকে না, অফিসে থাকে তাই স্টিকার ব্যবহার করা হয়। আর চালকের পরিচয়পত্র থাকে। তবে পেশাগত নিরাপত্তা ও সহযোগিতার জন্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়িতে স্টিকার ব্যবহারে চল আছে। যেমন সাংবাদিকেরা ব্যবহার করেন।”
তার কথা, “তবে এগুলো ব্যক্তিগত হতে পারে না। প্রতিষ্ঠানের হতে পারে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়িতে স্টিকার থাকতে পারে। কিন্তু কোনো কর্মকর্তার ব্যক্তিগত গাড়িতে স্টিকার থাকতে পারে না। তেমনি সংবাদ মাধ্যমের কাজে ব্যবহৃত গড়ির স্টিকার থাকতে পারে। কিন্তু একজন সাংবাদিক তার পরিবারের ব্যবহৃত গাড়িতে তো স্টিকার ব্যবহার করতে পারেন না।”
তার মতে, “স্পর্শকাতর পেশার ব্যক্তিরা যদি ব্যক্তিগত গাড়িতে স্টিকার ব্যবহার করেন তাহলে ট্রাফিক পুলিশের পেশাগত দায়িত্ব পালনে সমস্যা হয়। আইনের প্রয়োগে সমস্যা হয়।” গোয়েন্দা বিভাগের উপ পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, “এখন দেখছি ‘জরুরি রপ্তানি কাজে ব্যবহৃত’ স্টিকার গাড়িতে লাগিয়ে চোরাচালান হয়। আর অনেকেই আত্মীয় স্বজনকেও গাড়ির স্টিকার দেন। এক প্রতিষ্ঠানের স্টিকার সুবিধা নেয়ার জন্য অন্য প্রতিষ্ঠানের গাড়িতে লাগানো হয়।
তিনি বলেন, ‘‘স্টিকারের প্রাধিকার থাকতে পারে। কিন্তু সেটারও নীতিমালা থাকা প্রয়োজন । সেটা না থাকায় এটার অপব্যবহার হচ্ছে। ভুয়া স্টিকার ব্যবহার করে অপরাধ হচ্ছে।” রাজশাহী বিভাগীয় মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের গেয়েন্দা বিভাগের উপ পরিচালক মোহা. জিললুর রহমান বলেন, ‘‘স্টিকার ব্যবহারের নীতিমালা না থাকায় আমরা বিভ্রান্ত হই। এই নীতিমালা থাকা উচিত।
আগে সচিবালয় থেকে গাড়ির স্টিকার দেওয়া হতো। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে তা বন্ধ রয়েছে। সাংবাদিকসহ যারা সচিবালয়ে প্রবেশের স্থায়ী কার্ড পেতেন তাদের গাড়ির স্টিকার দেওয়া হতো। এখন নির্বাচন কমিশন ভোটের সময় সাংবাদিক এবং ভোটের কাজে নিয়োজিতদের গাড়ির স্টিকার দেয়।মেহেদী হাসান বলেন, এই অভিযানের অভিজ্ঞতায় আমরা গাড়ির স্টিকারের ব্যাপারে একটি নীতিমালা করার জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব করব।”
আর ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি সোহেল হায়দার চৌধুরী বলেন, সাংবাদিকসহ সরকারি বেসরকারি যাদেরই পেশাগত কাজে গাড়ির স্টিকার প্রয়োজন তাদের সেটা ব্যবহার করার অধিকার আছে। কিন্তু যারা সাংবাদিক নন, তারা যেন এটা ব্যবহার করতে না পারেন তার ব্যবস্থা করা দরকার। আর এই স্টিকার ব্যক্তিগত নয় প্রাতিষ্ঠানিক হওয়া দরকার। সাংবাদিক পরিচয়ের অপব্যবহার বন্ধ করা উচিত।