যেকোনো সময় বৈরী আবহাওয়া, সমুদ্রের রুদ্রমূর্তি ও জলদস্যুদের হামলার মুখে পড়ার শঙ্কা নিয়ে এক দেশ থেকে আরেক দেশের বন্দরে ছুটে চলেন তাঁরা। পরিবার–পরিজনের কাছে ফেরার সুযোগ মেলে দীর্ঘ সময় পর। সামাজিক জীবন বলতে কিছু সহকর্মী ও সহযাত্রীর সঙ্গে একই জাহাজে থাকা। এ রকম একটি ঝুঁকিপূর্ণ ও চ্যালেঞ্জিং পেশায় নিয়োজিত বাংলাদেশি নাবিকেরা প্রতিবছর প্রায় ৪০ কোটি মার্কিন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করেন, যার একটি অংশ তাঁরা ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ডে বিনিয়োগ করে আসছিলেন। কিন্তু সংজ্ঞার প্যাঁচের কারণে এখন আর নাবিকেরা এই বন্ডে বিনিয়োগ করতে পারছেন না।
সে জন্য বন্ডটিতে আবারও বিনিয়োগের সুযোগ চেয়ে বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএমওএ) মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি), বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরে গত এক বছরে তিন দফা চিঠি দিয়েছে। কিন্তু তাদের দাবি সরকারের কোনো দপ্তরই আমলে নিচ্ছে না বলে অভিযোগ বিএমএমওএর।
জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘নাবিকদের দাবির সঙ্গে আমি নীতিগতভাবে একমত। এ বিষয়ে অন্য দেশগুলোর চর্চাটি কী, তা আমি খোঁজ নেব। এরপর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করব।’
দেশে ১৯৮৮ সালে পাঁচ বছর মেয়াদি এই ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ড চালু করা হয়। বন্ডটির সুদের হার এখন ১২ শতাংশ। তবে বর্তমানে বিদেশে অবস্থান করা যেকোনো নাগরিক, লিয়েনে থাকা সরকারি কর্মচারী এবং বাংলাদেশি দূতাবাস ও হাইকমিশনগুলোয় কর্মরতরা এই বন্ড কিনতে পারেন।
২০২০ সালের আগস্ট থেকে কাগজে-কলমে নাবিকদের জন্য এই বন্ডে বিনিয়োগ করা বন্ধ রয়েছে। অথচ চালু হওয়ার পর থেকে ৩২ বছর ধরে এই বন্ডে বিনিয়োগ করে আসছিলেন নাবিকেরা। প্রজ্ঞাপন ছাড়াই ২০১৯ সালের শেষ দিক থেকে রাষ্ট্রমালিকানাধীন চার ব্যাংক নাবিকদের এই বন্ডে বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করে আসছিল। একদিকে বৈধ পথে রেমিট্যান্স আয় (প্রবাসী আয়) আনার জন্য ২ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে প্রবাসী আয় যাতে দেশে আসতে না পারে, সেই ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে বলে আপত্তি বিএমএমওএর।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘বিদেশি মালিকানাধীন শিপিং, এয়ারওয়েজ কোম্পানিতে চাকরিরত বাংলাদেশি মেরিনার ও পাইলট/কেবিন ক্রুদের এবং বাংলাদেশি মালিকানাধীন শিপিং/এয়ারওয়েজ কোম্পানিগুলোর বিদেশে থাকা অফিসে নিয়োগ পাওয়া এবং তা থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী মেরিনার ও পাইলট/কেবিন ক্রুদের ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ড কেনার সুযোগ নেই।’
পাইলট ও কেবিন ক্রুরা অবশ্য এ নিয়ে কোনো আপত্তি তোলেননি। তবে লিখিত আবেদনে বিএমএমওএ বলেছে, পেনশন, প্রভিডেন্ট ফান্ড বা অবসরোত্তর কোনো সুবিধা নেই নাবিকদের। শৃঙ্খলাবদ্ধ এই পেশাজীবীদের সংখ্যা এখন ১০ হাজার ৪০০। বাংলাদেশি একজন মেরিন কর্মকর্তা যখন বিদেশি পতাকাবাহী জাহাজে অবস্থান করেন, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী তখন তিনি ওই দেশের আওতায় থাকেন। সাধারণত ৪ থেকে ৯ মাসের চুক্তি হয় তাঁদের। চাকরির পূর্ণ মেয়াদকালে তাঁর পক্ষে নির্দিষ্ট কোনো দেশে অবস্থানের প্রমাণ দেখানো সম্ভব নয়।
বিএমএমওএর মতে, ওয়েজ আর্নার্স হয়েও নাবিকেরা ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ডে বিনিয়োগ করতে পারছেন না। অথচ তাঁরা বিদেশি ব্যাংক বা মানি এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে মজুরি ও বেতন দেশে পাঠান। তাঁদের মাধ্যমে দেশে বছরে প্রায় ৪০ কোটি ডলার আসে, যা বাংলাদেশের ৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকার সমান।
বিএমএমওএর যুক্তি হচ্ছে, জাহাজে যোগ দেওয়া থেকে জাহাজ থেকে নামার পর সংরক্ষিত সব তথ্য আন্তর্জাতিকভাবে বৈধ দলিল এবং বিশ্বের সব দেশে স্বীকৃত। আর ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ড বিধি ১৯৮১ (সংশোধিত ২০১৫) অনুযায়ী ওয়েজ আর্নার্সের সংজ্ঞা ও বন্ড কেনার যোগ্যতা অনুযায়ীই নাবিকেরা এই বন্ড কিনতে পারেন।
অবশ্য নাবিকদের বিনিয়োগের সুযোগ বন্ধ করে দেওয়ার এক বছর আগে ২০১৯ সালের ১৯ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংক আরেকটি প্রজ্ঞাপন জারি করে বলেছিল, বিদেশে অবস্থানরত সব বাংলাদেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী ও প্রেরণকারী তাঁদের উপার্জিত অর্থ ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ডে বিনিয়োগ করতে পারবেন। এক বছরের মাথায়ই তা পাল্টে গেল।
বিএমএমওএর সভাপতি মোহাম্মদ এনাম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বন্ধ করার পর নাবিকদের পাঠানো অর্থ অর্ধেকে নেমেছে। যৌক্তিক ও মানবিক কারণেই নাবিকদের ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ডে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া উচিত।’