মো মহসিন, উপজেলা প্রতিনিধি, বেগমগঞ্জ, নোয়াখালী: বেগমগঞ্জ সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্রে সপরিবারে আশ্রয় নেয়া চৌমুহনী পৌরসভার গনিপুর গ্রামের রেজাউল হক (৬০) কান্না কান্না কণ্ঠে বলেন, বসতঘর নিলো বন্যায়, পিকআপটি নিলো চোরে। এখন আমি কোথায় থাকি, কি করি? বন্যায় বাড়ির ঘরটি পানিতে ডুবে গেলে কোন মতে ছেলে মেয়েদের নিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে উঠি। স্থানীয় লোকজনের সাথে মিলে মিশে নিজের পিকআপে করে ত্রাণ সহায়তায় কাজ করছিলাম।
২৬ আগস্ট সোমবার কাজ শেষে রাতে স্কুল গেইটে গাড়িটি রেখে ঘুমাতে যান। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখেন গাড়িটি নেই। খোঁজাখুজি করে একমাত্র উপার্জনের মাধ্যম পিকআপটি আর পাননি। পার্শ্ববর্তী একটি সিসি ক্যামরায় দেখা গেল রাত ২টা ৪১ মিনিটে পিকআপটি চুরি করে নিয়ে গেছে সংঘবদ্ধ চোরের দল।
এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার ২৯ আগস্ট বেগমগঞ্জ মডেল থানায় অভিযোগ করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, গত এক বছর আগে ১০ লাখ টাকায় গাড়িটি কিস্তিতে কিনেছিলেন। এখনো তার তিন লাখ টাকা বকেয়া। এ গাড়ি ছাড়া উপার্জনের আর কোনো পথ নেই। সবাই মিলে তার গাড়িটি উদ্ধার করে তার পাশে দাঁড়াতে তিনি সকলের কাছে অনুরোধ করেন। বন্যা আর চোর তাকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। তার পিকআপটির নম্বর (চট্টমেট্রো-ন-১১-৯২৮১)।
এছাড়া, গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসেন তিনি। তাই এ বন্যায় লোকজনের সাহায্যের জন্য বিনা ভাড়ায় ত্রাণ কার্যক্রমে গাড়ি সরবরাহ করে আসছিলেন। তেলের টাকাও নিজের পকেট থেকে দিচ্ছিলেন।
বেগমগঞ্জ মডেল থানার কর্মকর্তা (ওসি) মো. আনোয়ারুল ইসলাম জানান, পিকআপ চুরির অভিযোগ পেয়েছে। গাড়ি উদ্ধারের ব্যবস্থা নেয়া হবে।
হানিফ কামাল নামের আরেক জন জানান, নিজের ঘরে ৩ ফুটের বেশি পানি হওয়ায় পার্শ্ববর্তী বাড়ির একজনের বিল্ডিংয়ের ছাদে ছিলাম পরিবার পরিজন নিয়ে। আপনাদের ত্রাণ সহায়তায় মোটামুটি দিন কেটে গেছে। এখন পানি কমতেছে। ঘরদোর কি দিয়ে ঠিক করবো,ভাড়ায় দেয়া রিক্সাগুলি পানিতে নষ্ট হয়ে অনেক ক্ষতি হয়েছে। সেগুলি মেরামত করার টাকা কোথায় পাবো-দুশ্চিন্তায় ঘুম আসে না।
আলাপ করে জানা গেলো, বিডিআরের অবসর প্রাপ্ত সৈনিক হানিফ অসুস্থ হয়ে বাড়িতেই থাকেন। বড় মেয়ে ঢাকা জগন্নাত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। হানিফের পেনশনের টাকায় কয়েকটা পুরানো রিকশা কিনে ভাড়ায় চালিয়ে ছেলে মেয়েদের পড়ালেখার খরচ মিটিয়ে সংসার চালাতো। বন্যায় তাকে দিশেহারা করে দিয়েছে।
উপজেলার গ্রামগঞ্জের ঘর-দোরে পানির কারণে নষ্ট হওয়া বেড়াগুলি ভেঙে চুরির ভয়ে আতঙ্কে সাধারণ মধ্য বিত্ত পরিবার। পানি থাকা কালে যারা আশ্রয় কেন্দ্রে ছিলেন, তাদের কারো কারো বাড়িতে চোর ঢুকেছে। এমন সংবাদ মসজিদ মাইকে প্রচার করায় চোরের দল তেমন ক্ষতি করতে পারেনি। বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশে আইন শৃঙ্খলা অবস্থা উদ্বেগজনক।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার আরিফুর রহমান জানান, উপজেলার ১৬টি ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে এবং বন্যায় মোটামুটি সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতষ্ঠানে ত্রাণ পাওয়া গেছে। তবে উপজেলা ভিত্তিক সমন্বয়ের অভাবে কিছু সমস্যা হয়েছে। বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে উঠার জন্য সরকারি সহায়তার পাশাপাশি স্থানীয় বিত্তবানদের সহযোগিতা খুবই জরুরি।
প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আহাম্মদ উল্লা সবুজ জানান, তার অফিসের লোকবল সমস্যা নিয়ে ১ লাখ ৩ হাজার ২৫টি পরিবারে ৪ লাখ ৭০ হাজার ৩শ জন ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মাঝে সরকারি, ২৭০ মে. টন চাল ও ৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা নগদ অর্থ বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারি ত্রাণ সহায়তা চোখে পড়ার মতো। তবে এ কাজে পরিবহণ সমস্যার কারণে যথেষ্ট অসুবিধা হয়েছে।
কৃষি অফিসের ফজলে এলাহীর তথ্য মতে, প্রায় ৯ কোটি টাকার আউশ আমন শাকসবজি-মশলার ক্ষতি হয়েছে। মৎস্য অফিসার মাসুমা আক্তারের মতে, প্রায় ১৬ কোটি টাকার মাছ এবং প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা শাহ পরানের মতে ১৫ কোটি টাকার প্রাণিজ সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। সরকারিভাবে সহযোগিতা না পেলে এ ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয় বলে তারা মনে করে।
এদিকে উপজেলা ৫০ শয্যা হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তা অসীম কুমার জানান, বন্যা জনিত কারণে প্রতি দিন শতাধিক রোগী চিকিৎসা নিচ্ছে। যা দিন দিন বাড়বে। গ্রাম এলাকাসহ রোগীদের প্রয়োজনীয় সেবা দিতে ডাক্তারের সমস্যা না থাকলেও কলেরা স্যালাইন, পানি বিশুদ্ধ করণ টেবলেটসহ প্রাসঙ্গিক ঔষধের বরাদ্দ বাড়ানো দরকার।
অপর দিকে গেল পনেরো দিনে বেগমগঞ্জ উপজেলা ও প্রথম শ্রেণি চৌমুহনী পৌরসভা গত দু সপ্তাহ ব্যাপী প্রায় শতাধিক স্থানে কোটি টাকা ত্রাণ ও খাদ্যসহ নানাবিধ সামগ্রী উপহার ও বিতরণ করেন বেগমগঞ্জ আসনের চার বারের সাবেক এমপি ও মন্ত্রী বরকত উল্যাহ। এ সময় তিনি ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন উপজেলা ও জেলা বিএনপির অঙ্গ সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।