বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির অকুণ্ঠ প্রশংসা করে আজ সোমবার সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে ভারতের প্রভাবশালী বাংলা সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজার পত্রিকা। সম্পাদকীয়টি হুবুহু তুলে ধরা হলো:
নবজাত দেশের নতুন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান যখন ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতার মাটিতে অবতরণ করিয়া ময়দানে বক্তৃতা শুরু করিলেন, ততক্ষণে সমগ্র কলিকাতা মহানগরই কলরোল-উচ্ছ্বসিত ময়দানে পরিণত হইয়াছিল। বঙ্গবন্ধু সে দিন কলিকাতার বুকে দাঁড়াইয়া কেবল উদাত্ত কণ্ঠে বিজয়বার্তা ঘোষণা করেন নাই, বিপন্ন এবং নিঃস্ব একটি নবজাত রাষ্ট্রের তরফে বাঙালির শুভেচ্ছাও প্রার্থনা করিয়াছিলেন। ঊনপঞ্চাশ বৎসর অতিক্রান্ত হইয়াছে, এই ফেব্রুয়ারিতে পঞ্চাশ বৎসরে পড়িল সেই দিনটির ইতিহাস। সে দিনের সদ্যোজাত ক্ষুদ্র দেশ এখন মহাগৌরবে উপমহাদেশীয় অঞ্চলের মুখোজ্জ্বল করিতে ব্যস্ত। বাংলাদেশের উন্নতি দেখিয়া এই উপমহাদেশের অন্যান্য দেশ, এমনকি তথাকথিত আঞ্চলিক মহাশক্তিরাও আজ ঈর্ষান্বিত। ঢাকার বিদেশি মুদ্রা ভাণ্ডার এখন ইসলামাবাদের তিনগুণ। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তানকে সুইডেন বানাইবেন বলিলে উপদেষ্টারা বলেন, আগে তো বাংলাদেশের সমকক্ষ হউন, তাহার পর সুইডেন। অন্য দিকে, আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডারের ২০২০ সালের হিসাব— জনপ্রতি জিডিপি-র দিক দিয়া বাংলাদেশ ভারতকে পিছনে ফেলিয়াছে। কোভিড-পূর্ব কালেই দুই দেশ এই স্থানে আসিয়াছিল। অতঃপর কোভিড-১৯ ভারতীয় অর্থনীতিকে বাংলাদেশের অর্থনীতির অপেক্ষা বিপন্নতর করিয়াছে। যেহেতু যে কোনও যাত্রারই চরিত্র নির্ধারিত হয় তাহার সূচনাবিন্দুর উপর নির্ভর করিয়া: ১৯৭২ সালে ভারত যে অবস্থায় ছিল, আর নতুন বাংলাদেশ (যাহাকে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হেনরি কিসিঙ্গার ‘বাসকেট কেস’ বলিয়া অভিহিত করিয়াছিলেন) যেখানে ছিল, তাহা মাথায় রাখিলেই বোঝা যায়, কে কতখানি আগাইয়াছে বা পিছাইয়াছে।
আইএমএফ-এর হিসাব আন্তর্জাতিক গোচরে আসিবার সঙ্গে সঙ্গে সক্রিয় ও উদ্বিগ্ন বিজেপি আইটি সেল বুঝাইতে শুরু করিয়াছে, কেন বাংলাদেশ ও ভারতের এই তুলনা আসলে বাস্তবের যথার্থ প্রতিফলন নহে। আইটি সেল-এর যুক্তিতর্কের ধরনধারণের সহিত পরিচিতরাই বুঝিবেন, কী ধরনের মারপ্যাঁচ এই বক্তব্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ব্যবহৃত হইয়াছে। বাংলাদেশের বস্ত্রশিল্প সেক্টরই তাহাকে কোভিড-সঙ্কটে বাঁচাইয়াছে, এমন যুক্তিও সেই মারপ্যাঁচে স্থান লইয়াছে— যদিও বোঝা দুষ্কর, ভারতকে সেই শিল্পে বা সমস্তরের কোনও শিল্পে মনোনিবেশ করিতে কে কবে বাধা দিতেছিল। আরও একটি কথা। উন্নয়ন বুঝিবার জন্য যে জিডিপি-ই একমাত্র হিসাবের খাতা নহে, মানুষের মৌলিক চাহিদা ও জীবনমানের পরিস্থিতিও যে তাহার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সূচক, এমন কথা অমর্ত্য সেন প্রমুখ অর্থনীতিবিদ বারংবার বলিয়াছেন। দেখাইয়াছেন, কীভাবে যে ভারত এক কালে মানব-উন্নয়ন সূচকে উপমহাদেশীয় তালিকার একেবারে উপরের দিকে ছিল, সে ক্রমে তালিকার নিম্নবর্গে স্থান লইয়াছে। ২০২০ সালের শেষে, নাগরিকের গড় আয়ু ভারতের অপেক্ষা বাংলাদেশে তিন বৎসর বেশি, শিশুমৃত্যুর হার ভারতের অপেক্ষা কম (হাজারে ভারত ২৮, বাংলাদেশে ২৫), সাক্ষরতায় দুই দেশ পাশাপাশি, শহর-জনসংখ্যার হারে বাংলাদেশ (৩৭ শতাংশ) ও ভারত (৩৪ শতাংশ) এবং— নারী কর্মসক্ষমতার দিক দিয়া বাংলাদেশ প্রভূত আগাইয়া (ভারত ২০ শতাংশ, বাংলাদেশ ৩৬ শতাংশ)। কে কোন দিকে অনুপ্রবেশ করিবে, তাহাই এখন প্রশ্ন। এই সমগ্র চিত্রের সমস্ত ‘দায়িত্ব’ যে দিল্লির বর্তমান শাসক দলকেই লইতে হইবে, এমন নহে, যদিও গত কয়েক বৎসরে পরিস্থিতি উপর্যুপরি খারাপ হইয়াছে। কিন্তু বর্তমান শাসকের ‘ঠাকুরঘরে কে’ ভাবটিই সাক্ষাৎ প্রমাণ, তাহারা নিজেরাই নিজেদের ‘অপরাধ’-এর ভাগিদার ভাবে। অথচ বাংলাদেশের সমৃদ্ধির মতো ঘটনাকে আইটি সেল-এর অপপ্রচারের হাতে ছাড়িয়া না দিয়া দিল্লির উচিত ছিল, অর্থনীতিবিদ ও সমাজতাত্ত্বিকদের সাহায্য লইয়া সেই দেশ হইতে কিছু শিক্ষা গ্রহণ করিবার।