বাংলাদেশে নির্বাচনের ইতিহাস সহিংসতার এবং অভ্যুত্থানের। আগামী ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচন সারাদেশে সবচেয়ে বড় ইস্যু, কোন পক্ষ বিজয়ী হবে তা-ই এখন দেখার বিষয়।
১৯৭৭ সালের ৩০ মে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রথমবারের মতো নির্বাচনী জালিয়াতির মাধ্যমে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়- এ ঘটনা এত সহজে মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি। দেশের প্রথম গণভোটে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীদের একজন এবং তৎকালীন সেনাপ্রধান ফলাফল কারচুপি করে নিজের স্বার্থ হাসিল করেছিলেন।
উচ্চাভিলাষী জেনারেল জিয়াউর রহমান, যিনি পরবর্তীতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন করেছিলেন। আক্ষরিক অর্থে সামরিক উর্দি পড়েই নেতৃত্ব দিয়ে তিনি নিজেই সার্ভিস আইন লঙ্ঘন করেছিলেন। তবুও, গণতন্ত্রের স্বঘোষিত গ্লোবাল-কপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে কোনও উদ্বেগ বা সতর্কতা আসেনি, বরং মার্কিনিরা নির্লজ্জভাবে জেনারেল জিয়ার পক্ষে ছিল এবং অনিয়মগুলোকে উপেক্ষা করেছিল।
একনায়কতন্ত্রকে সমর্থন করার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘ ঐতিহ্যের একটি নতুন অধ্যায় সূচিত হয়।
গত মাসে, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছেন, যেখানে বলা হয়েছে যারা ২০২৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করবে তারা যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাবে না ।
কয়েক দশক ধরে মার্কিনিরা সে সকল “সামরিক স্বৈরশাসকদের” আলিঙ্গন করেছে যারা “স্বৈরাচার বা পাকিস্তান-কায়দায় সামরিক শাসন” এর সংস্কৃতি চালু করেছিল।
“এই দেশের জন্ম ঠেকানোর প্রচেষ্টা থেকে শুরু করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে গণহত্যা চালানোর জন্য সর্বাত্মক সহায়তা প্রদানের জন্য মার্কিন প্রশাসন তখনকার সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য একটি পাক-কায়দার সামরিক শাসন চেয়েছিল,” বলেছেন গবেষক অজয় দাস গুপ্ত।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার চার বছরের মধ্যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তাদের একটি অংশের সাথে যোগসাজশ করে, যারা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবারের ১৯ সদস্যসহ গুলি করে হত্যা করে। তখন থেকে কয়েক দশক পেরিয়ে গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার রাশেদ চৌধুরীকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানোর আহ্বান জানিয়ে ব্যর্থ হন। রাশেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত।
অনুসন্ধানী সাংবাদিক এবং ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ-এর প্রাক্তন দক্ষিণ এশিয়ার সংবাদদাতা লরেন্স লিফশুল্টজের মতে, জিয়ার সমর্থন ছাড়া এই হত্যাকাণ্ডের পিছনে থাকা ব্যক্তিরা পালিয়ে যেতে পারতো না। তিনি আরও বলেন, আমেরিকার সমর্থন ছাড়া জিয়া এটা করতে পারতেন না।
২০০৬ সাল থেকে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশটি পরিচালনায় সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক শাসনের কথা উল্লেখ করে পর্যবেক্ষকরা বলেছেন, “তখন দেশটি কূটনীতিকদের খেলার মাঠে পরিণত হয়েছিল। শেখ হাসিনাসহ শীর্ষ রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে দুর্নীতির বানোয়াট কাহিনী ব্যাপকভাবে প্রচারিত হওয়ার পর শীর্ষ নেতৃবৃন্দদের কারারুদ্ধ করার ঘটনা ঘটে।”
“সংবিধান বহির্ভূত ও অসাংবিধানিকভাবে গড়ে উঠা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কারণে বাংলাদেশ বিদেশি কূটকৌশলের খেলার মাঠে পরিণত হয়েছিল, যা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন করেছে। এটি পরবর্তীতে আওয়ামী লীগকে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করার সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেছে।”
পশ্চিমা এবং প্রতিবেশী ভারতের নেতৃস্থানীয় গণতান্ত্রিক দেশগুলো যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন করতে পারে, বাংলাদেশও তা যুক্তিযুক্তভাবে সম্ভব,” বলেছেন সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত, যিনি বিবিসির সাথে কাজ করেছিলেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন প্রাক্তন উপদেষ্টা মন্তব্য করেছেন, “তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন সমস্ত সমস্যার সমাধান করতে পারে না, যদি তা স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারে।”
সেসময় প্রথম আলো এবং দ্য ডেইলি স্টার-সহ দেশের প্রথম সারির মিডিয়াগুলোকে ব্যবহার করা হয়েছিল, যারা “অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাকে স্বাগত জানিয়েছিল এবং এমনকি বিরাজনীতিকরণের জন্য সম্পাদকীয় অবস্থানও নিয়েছিল।” যাইহোক, ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মুখে এই সব ষড়যন্ত্র ধূলিস্যাৎ হয়।
সেই বিজয়ের পর, বাংলাদেশে দুটি জাতীয় নির্বাচন হয়, যার প্রথমটি ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি জামায়াত ভোট বর্জন করেছিল।
নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে নির্বাচন বানচালের উদ্দেশ্যে দল দুটি যানবাহনে ভয়াবহ আগুন সন্ত্রাস-বোমা হামলা চালায়। জামায়াত সারাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালিয়েছিল।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রণব পান্ডে সহিংসতার বিষয়ে বলেন, “নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করার দায়িত্ব অবশ্যই ক্ষমতাসীনদের, কিন্তু বিরোধীরা যদি নির্বাচন বর্জন করতে এবং সহিংসতা বন্ধ না করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকে, তাহলে কী হতে পারে? সরকার কি করবে? নির্বাচন থেকে বিরত থাকা বিএনপির একটি কৌশলগত ভুল ছিল।”
২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ নির্বাচন সম্পর্কে অভিযোগের বিষয়ে নবনিতা চৌধুরী, যিনি নেতৃস্থানীয় জাতীয় গণমাধ্যম এবং আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করেন, উল্লেখ করেন যে, “ভোট কারচুপির কোনও প্রমাণ বিরোধী দলের কেউ দেখাতে পারেনি।”
বিরোধীদের ভোটে “অনিয়ম” এর বক্তব্যে নবনিতা যোগ করে বলেন, “টক-শোতে, এই ধরনের অভিযোগ সম্পর্কে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল কিন্তু বিরোধী নেতারা তাদের দাবির স্বপক্ষে কোনও প্রমাণ দেখাতে সক্ষম হননি।”
তাছাড়া ২০১৮ সালের নির্বাচনে গণমাধ্যমে বেশ কয়েকজন বিরোধী নেতাকে ভোট কেন্দ্রে ভোট দিতে দেখা গেছে এবং ভোট প্রদান শেষে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে গণমাধ্যমে ব্রিফ করেন। তবে ভোট শেষ হওয়ার পর সুর পাল্টেছেন তারা।
বিএনপি ঘোষণা দিয়েছে যে তারা, ২০০৪ সালের গ্রেনেড হামলায় জড়িত থাকার দায়ে দোষী সাব্যস্ত তারেক রহমানকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনবে, যিনি ২০০৮ সাল থেকে সপরিবারে যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন।
তার আগমন এবং বিরোধী দলের নেতারা তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ছাড়া নির্বাচন বয়কট করার ঘোষণা দিয়ে তারা দেশজুড়ে সহিংসতার ভীতি ছড়িয়ে দিয়েছে।
এটা আশ্চর্যের কিছু নয় যে প্রধানমন্ত্রীকে প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি ১৯৭৫ সালের তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার পুনরাবৃত্তিকেই নির্দেশ করে। আওয়ামী লীগের অফিসে হামলা এবং “সর্বস্ব আন্দোলন” দিয়ে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার হুমকির পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ পদক্ষেপ বিরোধী দলকে টেবিলে বসানোর ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলবে বলে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়।