পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের আওতায় চারটি স্টেশনের নকশা পরিবর্তনের জন্য ব্যয় বাড়িয়ে প্রকল্প সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে রেল মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে ফরিদপুরের ভাঙ্গা জংশন, পদ্মা সেতুর দুই প্রান্তের মাওয়া ও জাজিরা স্টেশন এবং নড়াইল স্টেশনের অনুমোদিত নকশা পরিবর্তন করে ‘আইকনিক রেল স্টেশন’ নির্মাণের পরিকল্পনার কথা বলা হচ্ছে।
তাতে শুধু ভাঙ্গা জংশনের জন্যই ব্যয় বাড়তে পারে ২৮০ কোটি টাকা। মূল নকশায় এ স্টেশনের আধুনিকায়নে ৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা বরাদ্দ ধরা হয়েছিল। সেক্ষেত্রে ব্যয় বাড়বে প্রায় ৭৫ গুণ। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বাকি তিনটি স্টেশনের ব্যয় এখনো চূড়ান্ত না হলেও তাতে মোট ব্যয় কয়েকশ কোটি টাকা বাড়তে পারে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলপথ মন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, “পদ্মা নদীর ওপর বিশ্বমানের এবং সর্বাধুনিক একটি সেতু তৈরি হচ্ছে। এটার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল কিছুই আমরা বিশ্বমানের করতে চাই। “তাই ভাঙ্গা ও পদ্মা সেতুর দুই দিকের দুটি স্টেশনসহ চারটি স্টেশন পদ্মাসেতুর সঙ্গে মানানসই সর্বাধুনিক এবং মানুষের জন্য সকল সুযোগ সুবিধা নিয়ে তৈরি করতে চাই। তাই প্রকল্পটির ব্যয় বাড়বে এবং সংশোধনের প্রয়োজন হবে।”
২০১৮ সালের ২২ মে একনেকের অনুমোদন পাওয়া পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২১ হাজার ৩৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা ঋণ দিচ্ছে চীন। বাকি অর্থ সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে যোগান দেওয়া হচ্ছে।
ঢাকা থেকে পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে ভাঙ্গা, নড়াইল হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার রেল সংযোগ তৈরি হবে এ প্রকল্পের মাধ্যমে। চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড (সিআরইসি) ২০২৪ সালের মধ্যে এ কাজ শেষ করবে।
রেল মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের মূল নকশা অনুযায়ী ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত মোট ১৭টি স্টেশন থাকবে। এর মধ্যে ফরিদপুরের ভাঙ্গা, যশোরের রুপদিয়া এবং ঢাকার গেণ্ডারিয়ায় এখন যে স্টেশন আছে, তার আধুনিকায়ন হবে। বাকি ১৪টি হবে নতুন স্টেশন।
প্রকল্পটির ব্যয় পরিকল্পনায় নতুন-পুরনো মিলিয়ে ওই সতেরটি স্টেশনের জন্য মোট বরাদ্দ ধরা হয়েছিল ৩৬ কোটি ৬১ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। চারটি স্টেশনের নকশা পরিবর্তন হলে মোট ব্যয় কয়েক গুণ বাড়বে। প্রকল্প সংশোধনের ওই প্রস্তাব চূড়ান্ত হলে চলতি বছরের মধ্যেই তা একনেক সভায় উপস্থাপন করা হতে পারে বলে জানিয়েছেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে রেলপথ মন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, “শুধুমাত্র ভাঙ্গা স্টেশন নির্মাণে আসলে ২০০ কোটি টাকার মত ব্যয় বাড়তে পারে। বাকি ৮০ কোটি টাকা জমি অধিগ্রহণের জন্য প্রয়োজন হতে পারে।”
একটি স্টেশনের পেছনে ৭৫ গুণ ব্যয় বৃদ্ধির যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, “আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে উন্নীত করার লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার। সেই চিন্তা মাথায় না রাখলে আমরা টেকসই উন্নয়ন করতে পারব না।
“এখন এত বিপুল অর্থ খরচ করে আমরা যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছি, তা যেন আগামীর উন্নত বাংলাদেশের সঙ্গে মানানসই এবং টেকসই হয়। উন্নত বাংলাদেশের জনগণও যেন অনেক দিন ধরে এই প্রকল্পের সুফল ভোগ করতে পারে।”
নকশা পরিবর্তন করে প্রকল্প সংশোধন হলে তাতে বাস্তবায়নের ওপর ‘তেমন একটা প্রভাব পড়বে না’ বলেও মনে করছেন মন্ত্রী।
রেল মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, ২০২০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রেলভবনে একটি সভা হয়। সেখানে ভাঙ্গা জংশনকে আধুনিক চীনা স্টেশনের আদলে নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়।
পৃথক এন্ট্রি-এক্সিট, একসেস কন্ট্রোলসহ আধুনিক সুযোগ-সুবিধা রেখে ওভারহেড এই স্টেশন নির্মাণের পরিকল্পনা হচ্ছে, সেখানে প্রাকৃতিক আলো সমৃদ্ধ ওয়েটিং এরিয়া এবং ফুড কোর্ট, শপিংমল, হোটেলের মত কমার্শিয়াল স্পেসও থাকবে।
ওই সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ভবিষ্যতে হাইস্পিড রেলওয়ে নির্মাণ, ঢাকা-গেণ্ডারিয়া সেকশনে তিনটি লাইন নির্মাণের ফলে ভূমি স্বল্পতার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে গেণ্ডারিয়া স্টেশনেরও আধুনিকায়ন হবে।
প্রকল্পটির আওতায় যেসব স্টেশন হবে, তার প্রতিটিতেই লিফট, চলন্ত সিঁড়ি, সাধারণ সিঁড়ি ও ফুটওভার ব্রিজ অথবা আন্ডারপাস নির্মাণেরও উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে সেদিন সিদ্ধান্ত হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক গোলাম ফখরুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, “মন্ত্রী মহোদায় যেভাবে চাইবেন আমাদের সেভাবেই কাজ করতে হবে।”
তিনি জানান, ভাঙ্গা জংশনের জায়গায় চীনা আদলে বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য প্রকল্পটির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিআরইসিকে বিস্তারিত নকশা (ডিটেইল্ড ডিজাইন) ও ব্যয় প্রাক্কলন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে।
ওই নকশা চূড়ান্ত হওয়ার পর জানা যাবে ভাঙ্গা জংশনকে চীনা স্টাইলে নির্মাণে ঠিক কত টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হতে পারে। এরপর নড়াইল রেল স্টেশন চীনা স্টাইলে নির্মাণের নকশা প্রণয়নের নির্দেশনা দেওয়া হবে।
প্রকল্পের আর কোন কোন অংশ সংশোধনের প্রয়োজন রয়েছে, তা নির্ধারণে এখন কাজ চলছে বলে জানান প্রকল্প পরিচালক। তিনি বলেন, “এ বছরের শেষ দিকে সব চূড়ান্ত করে কত টাকা ব্যয় বৃদ্ধি পাবে তা নির্ধারণ করে সংশোধনের জন্য একনেক সভায় উপস্থাপন করা হতে পারে।”
প্রকল্প সংশোধনে ব্যয় বাড়লেও ২০২৪ সালে নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যেই কাজ শেষ হবে বলে আশাবাদী প্রকল্প পরিচালক। তিনি বলেন, “এখনো অনেক সময় আছে। আমরা এই সময়ের মধ্যে সকল কাজ শেষ করতে পারব বলে আশাবাদী।
“প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে যে দিন থেকে গাড়ি চলাচল শুরু হবে, সেদিন থেকেই পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে রেল চলাচলও শুরু করতে আমরা প্রস্তুত।