1. [email protected] : admin :
  2. [email protected] : জাতীয় অর্থনীতি : জাতীয় অর্থনীতি
মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৩৯ অপরাহ্ন

মহীয়সী নারী জাহানারা ইমামের ৯২তম জন্মবার্ষিকী আজ

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • আপডেট : সোমবার, ৩ মে, ২০২১

আজ সোমবার ৩ মে, শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ৯২তম জন্মবার্ষিকী। মুক্তিযুদ্ধে স্বামী ও সন্তানহারা বরেণ্য এই লেখক ও সমাজকর্মীর উদ্যোগেই আজ থেকে ২৯ বছর আগে মুক্তিযুদ্ধকালের মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে আন্দোলন গড়ে ওঠে। গণ-আদালতে প্রতীকী বিচার হয় জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমের।

একাত্তরের গণহত্যাকারী, মানবতাবিরোধী অপরাধী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং জামায়াত-শিবিরের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গড়ে তোলা হয়। এই কমিটির উদ্যোগে ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত গণ-আদালতে গোলাম আযমের প্রতীকী বিচার হয়, যা দেখতে তৎকালীন সরকারের হুমকি ও বাধা অগ্রাহ্য করে বিপুলসংখ্যক মানুষ অংশ নেয়।

আশির দশকের শেষের দিকে ‘সচিত্র সন্ধানী’ ম্যাগাজিনে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’। আমাদের বাসায় অন্যান্য পত্রিকার সঙ্গে ‘সচিত্র সন্ধানী’ও রাখা হতো। আমরা ছোটরাও পাতা উল্টিয়ে ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’, ‘সচিত্র সন্ধানী’ ইত্যাদি ম্যাগাজিন দেখতাম। ‘সচিত্র সন্ধানী’ দেখতে গিয়ে নজরে আসে একাত্তরকে নিয়ে লেখা তাঁর কালজয়ী দিনপঞ্জি। বয়স কাঁচা হলেও জাহানারা ইমামের লেখার মধ্যে যে অদ্ভুত জাদু রয়েছে, তার কল্যাণে নিজের অজান্তেই ‘একাত্তরের দিনগুলি’র নিয়মিত পাঠক হয়ে যাই। একাত্তরে তাঁর সন্তান রুমী ও রুমীর সঙ্গীদের বীরত্বগাথা এবং এসব কেন্দ্র করে তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া ট্র্যাজেডি তিনি এমন হৃদয়-নিংড়ানো ভাষায় বর্ণনা করেছেন যে সময়ান্তে অন্য আরও পাঠকের মতো রুমী, বদি, জুয়েল, আলম, আজাদ, মায়ারা আমার মনের গভীরেও ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার স্থায়ী আসন করে নেন। একই সঙ্গে আমার হৃদয়ে লেখিকা জাহানারা ইমামের প্রতি ছেলেবেলায় তৈরি হওয়া ভালোবাসার সঙ্গে যোগ হয় একজন শহীদজননীর প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধাবোধ। তাঁকে প্রথম দেখি আশির দশকের একেবারে শেষের দিকে বাংলা একাডেমির বইমেলায়। আমার সহোদরাসম ফৌজিয়া আপা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষের দিকে আঙুল নিবদ্ধ করে বলেন, ‘ওই যে দেখ, উনি জাহানারা ইমাম। রুমীর মা।’ কলাপাতা শেডের মার্জিত শাড়ি পরিহিত ববছাঁট চুলের এই ‘ভালো লাগা’ মানুষটির মুখে তখন শেষ বিকেলের কিরণ এসে এমন এক মায়াময় আভা তৈরি করেছে যে তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ প্রগাঢ় থেকে প্রগাঢ়তর হয়। তখনো জানি না, এই মহীয়সী নারীর এত কাছে আসতে পারব কোনো দিন এবং কাজ করব একসঙ্গে একই অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য!

সে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলাম এর কয়েক বছর পরেই ১৯৯১ সালের শেষে। তিনি ১৯৯৪ সালের জুনে চলে গেলেন আমাদের সবাইকে ছেড়ে কিন্তু শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার ঋণে বেঁধে গেলেন এমন করে যে তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোর, ভালোবাসার অনুভূতি অটুট থাকবে চিরদিন। মনে পড়ছে, গণমানুষের তীব্র আন্দোলনের মুখে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতন ঘটার পর দেশে গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধ চেতনার বিকাশ ঘটবে, তেমন প্রতিশ্রুতি ছিল তিন জোটের রূপরেখায়। কিন্তু ঘটল ঠিক তার উল্টো ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর সহযোগিতা নিয়ে খালেদা জিয়া সরকার গঠন করার অব্যবহিত পর পাকিস্তানের নাগরিক গোলাম আজমকে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের আমির হিসেবে প্রকাশ্য ঘোষণা দেওয়ায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষের যেন ‘সংবিৎ’ ফিরে এল। এর ফলে আমরা ৩০ লাখ শহীদের রক্তে অর্জিত বাংলাদেশে, নাকি মুক্তিযুদ্ধে পরাভূত দেশ পাকিস্তানে বসবাস করছি, তার হিসাব মেলানোর প্রশ্নটি জরুরি হয়ে পড়ল। এই প্রশ্ন মেলানোর কাজে ধর্ম-বর্ণ-বয়স-লিঙ্গ-পেশা-স্থান-সামাজিক অবস্থান-নির্বিশেষে সবাই এক ছাতার তলে আসার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে থাকার এ সন্ধিক্ষণে জন্মলাভ করল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি, যার আহ্বায়ক হিসেবে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব বর্তাল জাহানারা ইমামের ওপরে। মুক্তিযুদ্ধ পক্ষের সব রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক শক্তি তখন জাতীয় সমন্বয় কমিটির ছাতার তলে সমবেত হয়ে এই আন্দোলনকে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটি করছে। শহীদের সন্তানদের সংগঠন প্রজন্ম ’৭১ এই আন্দোলনে শক্তিশালী অনুঘটক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সুযোগ পেয়েছে এবং সেই সূত্রেই বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনের প্রায় শেষ প্রান্তে তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সুযোগ আসে। তাঁর মতো একজন মহীয়সী নারীকে খুব কাছ থেকে দেখতে পাওয়ার এবং তাঁর সঙ্গে থেকে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের জন্য কাজ করতে পারার সুযোগ লাভ আমার জীবনের একটি অমূল্য অভিজ্ঞতা। এ নিয়ে দীর্ঘ কলেবরে লিখব পরে।

ভিয়েতনাম যুদ্ধে যারা নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছিল, তাদের বিচারের দাবিতে দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল ‘পাবলিক ট্রায়াল’-এর আয়োজন করেছিলেন, যা সারা বিশ্বে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। সেই একই আদলে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধী শিরোমণি গোলাম আযমের জন্য ‘গণ-আদালত’ গঠন করে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিচারের আয়োজন করে জাতীয় সমন্বয় কমিটি। এ কাজে যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী সহযোগিতা করতে আগুয়ান হলে দেশে-বিদেশে এই আন্দোলন ব্যাপক সাড়া জাগায়। যদিও দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ তখন ভীষণ বৈরী ছিল, কিন্তু জাহানারা ইমামের ডাইনামিক নেতৃত্ব তরুণ প্রাণ আন্দোলিত করতে সমর্থ হয়, ফলে তরুণেরা দলে দলে ঘাতক-দালালবিরোধী আন্দোলনে শামিল হয়। আজ ২০১৭ সালে এসে স্মরণ করছি, কী ভয়ংকর সময় পার করে এসেছি আমরা! সবচেয়ে বড় অন্তরায় ছিল এই আন্দোলনের প্রতি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় গঠিত সরকারের অগণতান্ত্রিক মনোভাব এবং এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে জামাত-শিবির-ফ্রিডম পার্টি-যুবকমান্ডের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের প্রতি সরকারের প্রশ্রয় ও মদদ দান। সর্বোপরি, খালেদা জিয়া সরকারের রাজনৈতিক দর্শনই ছিল স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষাবলম্বন করা, যার নিকৃষ্টতম পদক্ষেপ ছিল হত্যাকারী ও হত্যার পরিকল্পনাকারীদের বিচার চাওয়ার অপরাধে শহীদজননী জাহানারা ইমামসহ গণ-আদালতের উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের করা। আন্দোলনের তীব্রতায় ১৯৯২ সালের ২৯ জুন সরকার বাধ্য হয় সংসদে বিরোধী দলের সাংসদদের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করতে। কিন্তু সরকার তা বাস্তবায়ন না করে চড়াও হয় আন্দোলনের নেত্রী জাহানারা ইমামের ওপর। খালেদা জিয়ার লেলিয়ে দেওয়া পুলিশ বাহিনী প্রকাশ্য দিবালোকে জাহানারা ইমামকে লাঠিপেটা করে। অন্যায় আচরণের স্টিমরোলার চলতেই থাকে। কিন্তু জাহানারা ইমাম অটল থাকেন তাঁর দাবিতে। এ কথা অনস্বীকার্য, রাজনৈতিকভাবে বঙ্গবন্ধুকন্যা, তখন সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী, জাহানারা ইমামের পাশে কায়মনে থাকায়, তিনি তাঁর লক্ষ্যের দিকে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যেতে পেরেছেন। সঙ্গে অন্যান্য সংগঠনও তাঁকে এগিয়ে যেতে সাহস জুগিয়েছে।

বিরানব্বই সালের অক্টোবরে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সন্তানদের সংগঠন প্রজন্ম ’৭১-এর প্রথম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর উদ্বোধন করেন শহীদজননী জাহানারা ইমাম। ঢাকার নীলক্ষেতসংলগ্ন এলাকার বাংলাদেশ পরিকল্পনা একাডেমিতে হয়েছিল সেই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠান। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আগত শহীদ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তিনি দীর্ঘ সময় কাটান। এই প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আমরা ‘উত্তরসূরি’ নামের একটি সংকলন প্রকাশ করি। সংকলনটিতে প্রকাশের জন্য জাহানারা ইমামের একটি নাতিদীর্ঘ সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলাম। এই সাক্ষাৎকারে তরুণদের উদ্দ্যেশে কিছু বলতে বলা হলে শহীদজননী যা বলেছিলেন, তার গুরুত্ব আজকের বাস্তবতায় একটুও কমেনি। তিনি তরুণদের ভয় না পেয়ে সাহসী হতে বলেছিলেন, কেননা তাঁর মতে, ‘সাহসই হচ্ছে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার’। আরও বলেছিলেন, ‘একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে উদ্যোগী হও। কেউ বিকৃত করতে চাইলেও তা মুখ বুজে মেনে নেবে না। খুঁজে বের করো আসলেই কী ঘটেছিল একাত্তর সালের ওই নয় মাসে।’ তিনি তরুণদের বলেছেন যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন এবং যারা মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন, তাঁদের কাছ থেকে কী ঘটেছিল, তা জেনে নিতে। বলেছেন, ‘কোটি কোটি মানুষ এখনো বুকে গভীর ক্ষত ও যাতনা নিয়ে বেঁচে আছেন। তাঁদের কাছে যাও, তাঁদের কাছ থেকে জেনে নাও মুক্তিযুদ্ধের আসল ইতিহাস।’ এ যেন যুদ্ধজয়ের জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর সৈন্যদলের প্রতি প্রধান সেনাপতির অলঙ্ঘনীয় আদেশ! ম্যাক্সিম গোর্কির বিখ্যাত উপন্যাস ‘মাদার’-এর নায়ক পাভেল ভ্লাসভের মা যেমন ‘নবযুগ’-এর স্বপ্ন দেখা তরুণ বিপ্লবীদের দানবশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার সাহস জুগিয়েছেন, উদ্দীপিত করেছেন, শহীদজননী জাহানারা ইমাম সে কাজই করেছেন আমাদের দেশে। তরুণ প্রজন্মের মনে মুক্তিযুদ্ধের হৃতচেতনা ফিরিয়ে আনার সাহস জুগিয়েছেন, ঘাতকশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার সংকল্প তৈরি করতে প্রেরণা জুগিয়েছেন। তাই তো জাহানারা ইমাম চিরদিন টিকে থাকবেন বিশ্বমানবতার মুক্তির আন্দোলনে।
তৌহীদ রেজা নূর: প্রজন্ম ’৭১-এর প্রথম সাধারণ সম্পাদক।

Please Share This Post in Your Social Media

এই বিভাগের আরো সংবাদ
© ২০২০ দৈনিক জাতীয় অর্থনীতি