ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে উচ্চ বেতনে চাকরি দেওয়ার মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে নিরীহ ও বেকার যুবকদের কাছ থেকে প্রায় ৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি চক্র।
এ চক্রের মূলহোতা মাহবুব উল হাসান (৫০) ও তার প্রধান সহযোগী মাহমুদ করিমকে (৩৬) গ্রেফতারের কথা জানিয়েছে র্যাব-৩।
আজ শুক্রবার (৭ অক্টোবর) দুপুরে কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন র্যাব-৩-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, এ পর্যন্ত তারা বিভিন্ন অসহায় দরিদ্র লোকের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। চক্রের মূল হোতা মাহবুব উল হাসান এবং তার প্রধান সহযোগী মাহমুদ করিম। তারা বাংলাদেশে বিভিন্ন অঞ্চলে দালালের মাধ্যমে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যেতে ইচ্ছুক লোকজনের পাসপোর্ট সংগ্রহ করেন। এভাবে তারা গত দুই বছরে ৫২১টি পাসপোর্ট সংগ্রহ করেছেন।
বিদেশ যেতে ইচ্ছুক মানুষদের টার্গেট করে অগ্রিম অর্থ আদায় করত চক্রটি। এর মধ্যে যারা মধ্যেপ্রাচ্যে যেতে ইচ্ছুক তাদের কাছ থেকে ২-৩ লাখ টাকা করে এবং যারা ইউরোপে যেতে ইচ্ছুক তাদের কাছ থেকে ৬-৭ লাখ টাকা করে জমা নেয়।
এরপর বিভিন্ন কোম্পানির নামে চাকরির ভুয়া নিয়োগপত্র, ভুয়া মেডিকেল সার্টিফিকেটসহ বিভিন্ন ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে তাদের বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে নিশ্চয়তা প্রদান করে। কিন্তু পরে বিদেশে যাওয়ার কোনো কার্যক্রম না দেখে টাকা ফেরতের জন্য তাগাদা দিলেও তারা কোনো ভিকটিমকে টাকা ফেরত দেয়নি।
র্যাব-৩-এর সিও বলেন, গত দুই বছরে পাসপোর্ট এবং অর্থ জমাদানকারী কোনো ভিকটিমকে তিনি বিদেশে পাঠাতে পারেননি। এরপরও তিনি নিয়মিতভাবে দালালদের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকার মানুষজনের কাছ থেকে বিদেশে যাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে অর্থ সংগ্রহ অব্যাহত রেখেছেন।
এভাবে প্রতারণার মাধ্যমে সংগ্রহকৃত অর্থের পরিমান বৃদ্ধি পেলে অর্থসহ গ্রেফতার দুজন বিদেশে পাড়ি জমানোর পরিকল্পনা করেছিল। মাহবুব এখন পর্যন্ত বিদেশে পাঠানোর কোন এজেন্সির কাছে সংগ্রহ করা কোনো পাসপোর্ট জমা দেননি এবং অর্থ জমাদানকারী ভিকটিমদের বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে কোনো কার্যক্রম চালাননি।
গ্রেফতার মাহবুব ২০০০ সাল থেকে সংঘবদ্ধ মানব পাচার ও প্রতারক চক্রের সদস্য। তিনি বিদেশে উচ্চ বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে মধ্যেপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে প্রতারণার মাধ্যমে কিছু লোক পাঠান। তাদের প্রলোভনে পড়ে ভিকটিম এবং তাদের অভিভাবকরা রাজি হলে প্রথমে তারা পাসপোর্ট এবং প্রাথমিক খরচ বাবদ ১-২ লাখ টাকা নেন।
তারপর ভিকটিমদেরকে বিদেশ থেকে তাদের বিভিন্ন দালালের মাধ্যমে ফোন দিয়ে তাদেরকে আশ্বস্ত করেন, মাহবুবের মাধ্যমে বিদেশ গিয়ে তারা খুব ভাল আছে এবং অনেক অর্থ উপার্জন করছেন। বিদেশ থেকে ফোন পেয়ে ভিকটিমরা আরো অধিক আগ্রহী হন। এ সুযোগে চক্রটি ভিকটিমদের কাছ থেকে ধাপে ধাপে টাকা আত্মসাৎ করতে থাকে।
অন্যদিকে গ্রেফতাররা ফ্লাইটের আগে ভিকটিমের পাসপোর্ট, ভিসা কিংবা টিকেট কোনো কিছুই হস্তান্তর করে না। কখনো কখনো মাহবুব প্রতারণার মাধ্যমে ভিকটিমদেরকে কাজের বদলে ভ্রমণ ভিসায় বিদেশে পাঠিয়ে থাকে। সেখানে গিয়ে চক্রের সদস্যদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা ছাড়া ভিকটিমের কিছুই করার থাকে না।
বিদেশে পৌঁছার পর সেখানকার এজেন্টের মাধ্যমে আবারও প্রতারিত হতে হয় ভিকটিমদের। তাদেও কাজের নামে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে বন্দি করে রাখা হয়। এরপর শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন করা হয়। এ সময়ে মাহবুবের সঙ্গে যোগাযোগ করলে সে ভিকটিমদের অপেক্ষা করতে বলে। সে জানায় কিছুদিন পরে কোম্পানি চালু হবে। তখন তারা বেতন ও কাজের সুযোগ পাবেন।
এ সময়ে ভিকটিমরা নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে অনেকে নিজেদের চেষ্টায় টিকিট জোগাড় করে দেশে আসার চেষ্টা করেন। এরপর ভিকটিম দেশে ফিরে এলে মাহবুব অভিভাবক এবং ভিকটিমদের উল্টো দোষারোপ করেন।
এভাবে করোনার আগ পর্যন্তু মালয়েশিয়া, দুবাই এবং সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রচ্যের বিভিন্ন দেশে ভিকটিমদের পাঠিয়ে প্রতারিত করে তাদের নিকট থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন মাহবুব।
র্যাব-৩-এর সিও বলেন, গ্রেফতারদের ট্রাভেল এজেন্সি বা রিক্রুটিং এজেন্সি পরিচালনার কোনো লাইসেন্স নেই। স্বল্প সময়ে, বিনাশ্রমে অধিক লাভ বা অর্থ উপার্জনই তাদের একমাত্র লক্ষ্য। ভিকটিমরা বিদেশ গিয়ে কোনো কাজ না পেয়ে সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার এবং আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তাদের কোনো অনুশোচনা নেই।
গ্রেফতার মাহবুব উল হাসান এসএসসি পর্যন্ত পড়ালেখা করে ১৯৯৩ সালে মালয়েশিয়ায় যান। ৫ বছর পর দেশে ফিরে কৃষি কাজ শুরু করেন। স্বল্প পরিশ্রমে অধিক অর্থ উপার্জনের আশায় অবৈধভাবে ২০০০ সাল থেকে এক এজেন্সির মাধ্যমে মধ্যেপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে লোক পাঠানো শুরু করেন তিনি। ওই এজেন্সি থেকে চাহিদা অনুযায়ী টাকা না পাওয়ায় ২০১৪ সালে আরেকটি এজেন্সির মাধ্যমে কাজ শুরু করেন। ২০১৯ সাল পর্যন্ত তার পাঠানো প্রত্যেকেই বিদেশে গিয়ে কাজ না পেয়ে দেশে ফিরে এসেছেন।
এরপর কোনো ট্রাভেল এজেন্সির সাহায্য ছাড়াই কোটিপতি হওয়ার আশায় নিজেই অবৈধভাবে একটি অফিস খুলে মিথ্যা প্রলোভন ও প্রতারণার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন।