চারদিকে বিস্তৃত জলরাশি। ইঞ্জিনের নৌকার ভটভট শব্দ, যাত্রী ও মালবাহী লঞ্চের ভেঁপুর ডাক, ঝাঁকে ঝাঁকে তীরে পৌঁছাচ্ছে রুপালি ইলিশভর্তি নৌকা। পাশেই রয়েছে ইলিশ নিলামে তোলার এবং রপ্তানি প্রকিয়াজাতকরণের অনেকগুলো ছোট-বড় আড়ত।
বলছি ইলিশের বাড়িখ্যাত চাঁদপুরের কথা। মেঘনা, পদ্মা আর ডাকাতিয়া–অধ্যুষিত জেলাটি খ্যাতি পেয়েছে ইলিশের বাড়ি হিসেবে। ভরা মৌসুমে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ে এখানকার জেলেদের জালে। আর তাই ইলিশই হয়ে উঠেছে এই জেলার ট্রেডমার্ক।
শুধু ইলিশের জন্য নয়, এই সময়টাতে পর্যটকে ভরপুর থাকে চাঁদপুর। তাজা ইলিশ খাওয়া কিংবা কেনার বাইরেও যে জিনিসটি এখানে পর্যটক টেনে আনছে তা হলো, নদীর মাঝখানে জেগে ওঠা চর, যার আরেক নাম ‘মিনি কক্সবাজার’।
নদীর মাঝখানে জেগে ওঠা এই চরকে বিচের আদলে তৈরি করেছে চাঁদপুর জেলা প্রশাসন। এর মনোরম পরিবেশ আর ঠান্ডা জলের জন্য ছুটে আসেন অনেকেই।
উৎপত্তি ও অবস্থান
চাঁদপুরের ত্রিনদী (পদ্মা, মেঘনা, ডাকাতিয়া) মোহনা বড়স্টেশন মোলহেড থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে পদ্মা ও মেঘনার মিলনস্থলের দক্ষিণ–পূর্ব অংশে একটি বালুময় ভূমি এই মিনি কক্সবাজার। নদীভাঙন আর গড়ার মধ্যেই প্রাকৃতিকভাবে এ স্থানটির উৎপত্তি।
এটি নদীকেন্দ্রিক বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্যটনকেন্দ্র। এর চারদিকে নদীবেষ্টিত হওয়ায় কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের মতো দেখায়।তাই পর্যটকেরা এর নাম দিয়েছেন মিনি কক্সবাজার। স্থানীয়ভাবে বালু চর, পদ্মার চর ও মেঘনার চর নামেও এর পরিচিতি রয়েছে। বেসরকারিভাবে ‘স্বপ্ন ট্যুরিজম’–এ পর্যটন কেন্দ্রটি পরিচালনা করছে।
নদীপৃষ্ঠ থেকে কিছুটা উঁচু হওয়ায় শুষ্ক ও বর্ষা মৌসুমের ভরা জোয়ারেও এটির পুরো অংশ পানিতে ভেসে যায় না। বছরজুড়ে পর্যটকদের আনাগোনা থাকে। ২০১৮ সালের শুরুর দিক থেকে মিনি কক্সবাজার ধীরে ধীরে দেশব্যাপী মানুষের কাছে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে শুরু করে।
আকর্ষণীয় হওয়ার কারণ
চারদিকে নদী ও দূর থেকে পর্যটনকেন্দ্রটি দক্ষিণ–পূর্বাংশে চাঁদপুর জেলা শহরকে এবং এর বিপরীত দিকে ছোট আকৃতিতে শরীয়তপুর জেলাকে ফুটিয়ে তোলে, যা এই পর্যটনকেন্দ্রের বিশেষ আকর্ষণ। প্রধানত শীত মৌসুমে এবং গ্রীষ্মের আগ পর্যন্ত এ পর্যটনকেন্দ্র পর্যটকদের আনাগোনায় ভরপুর থাকে।
সকালে বা বিকেলে এসে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দুটি দৃশ্যই এখান থেকে দেখা যায়। সূর্যাস্তের সময় নদীর ঢেউয়ে যে মনোরম আলোর প্রতিফলন তৈরি হয়, তা সীমারের হৃদয়কেও করুণ এবং অদ্ভুত মমতায় ভরিয়ে দেবে বলেই পর্যটকদের বিশ্বাস। এ মোহকে তাই এক অতিলৌকিক ফাঁদই বলা যায়।
পাশাপাশি দুদিক থেকে দুই নদীর ছোট ছোট ঢেউয়ের আছড়ে পড়া, পদ্মা-মেঘনায় জেলেদের ইলিশ ধরার দৃশ্য আর বিস্তীর্ণ বালুর ফাঁকে সবুজ ঘাস মিনি কক্সবাজারের বিশেষ সৌন্দর্য। এ ছাড়া এখানে পর্যটকদের জন্য মেঘনা ও পদ্মা নদীর মিঠা পানিতে সাঁতারের পাশাপাশি ও গোসলের সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া চরে পিকনিক বা চড়ুইভাতি করারও সুযোগ রয়েছে।
ঝুঁকি ও সতর্কতা
মিনি কক্সবাজার, চাঁদপুর বর্ষা মৌসুমে সাঁতার না জানা পর্যটকদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। গত বছরের ১২ জুনে এখানে সাঁতার কাটতে এসে একজন পর্যটক নিখোঁজ হন। পরদিন ফায়ার সার্ভিস, বাংলাদেশ নৌ–বাহিনী ও কোস্টগার্ড সদস্যরা লাশ উদ্ধার করেন। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড এ পর্যটনকেন্দ্রকে চাঁদপুর শহর রক্ষা বাঁধের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে দেখছে। যারা সাঁতার জানেন না, তাঁরা ভ্রমণের সময় বোটে ওঠার আগে লাইফ জ্যাকেট, টায়ার নিয়ে উঠবেন।
খাবার-দাবার
এখানকার সব হোটেলেই ইলিশভাজা খেতে পাওয়া যায়। তবে নায্যমূল্যে খেতে যাচাই-বাছাই করে খেতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিআইডাব্লিউটির ক্যানটিন তুলনামূলক ভালো। সেখানে কাঁচা কিনে বা সরাসরি ভেজে দুভাবেই ইলিশ নেওয়া যায়।
দাম তুলনামূলকভাবে সস্তা। ৫০০ গ্রাম থেকে ১ কেজি ওজনের ইলিশ প্রতি পিস পাবেন ৩৫০-৫০০ টাকার মধ্যে। এর চেয়ে বড় সাইজের ওজন অনুসারে দামের হেরফের হতে পারে।
এখানকার নদীর তাজা ইলিশ আর বেগুনভাজার স্বাদ অতুলনীয়। ইলিশের লেজের ভর্তা, রসুন-মরিচভর্তা, আলুভর্তাসহ বিভিন্ন মাছের ও বিভিন্ন রকমের ভর্তাও পর্যটকেরা আয়েশ করেই খান।
এ ছাড়া নদীর বোয়াল, পাবদাসহ নানা রকমের বড়-ছোট মাছ পাওয়া যায় হোটেলগুলোতে। সময় পেলে চাঁদপুরের মতলব হয়ে মতলবের ক্ষীরও নিয়ে বাড়ি ফেরেন অনেকেই। ৬০০ টাকা কেজির এই ক্ষীরের সুনাম ইতিমধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে।
ঢাকা থেকে যেভাবে মিনি কক্সবাজার
ঢাকার সদরঘাট থেকে চাঁদপুর অভিমুখী বেশ কয়েকটি লঞ্চ আছে। বোরাক, রফ রফ ইত্যাদি। এগুলোতে কেবিন পাওয়া যায়, দাম হাতের নাগালেই। তবে নদীপথের সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে ডেকে ভ্রমণ করতে হবে।
এ ছাড়া সড়কপথেও আসা যায়। সে ক্ষেত্রে ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে ছেড়ে আসা পদ্মা এক্সপ্রেসে করে আসতে পারেন। তিন-চার ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছাতে পারবেন। দিনে এসে দিনে ঘুরে যাওয়া যায় চাঁ ।
লেখক ও ছাবিঃ মাছুম কামাল