মুসা বিন শমসেরকে ঘণ্টা তিনেক জিজ্ঞাসাবাদের পর পুলিশ বলেছে, আলোচিত এই ব্যক্তির বিপুল সম্পদের কথা শোনা গেলেও বাস্তবে তা নেই। তাঁর সম্পদের গল্পকে প্রতারণার কাজে লাগিয়েছেন ভুয়া অতিরিক্ত সচিব আবদুল কাদের।
প্রতারণার মাধ্যমে ঢাকা ও গাজীপুরে একাধিক ফ্ল্যাট–বাড়ির মালিক হওয়া আবদুল কাদেরকে গত বৃহস্পতিবার গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে তাঁর সঙ্গে মুসা বিন শমসেরের সংশ্লিষ্টতার তথ্য বেরিয়ে আসে। এর জের ধরে ডিবির তলবে মঙ্গলবার বিকেলে স্ত্রী–ছেলেকে নিয়ে মিন্টো রোডে হাজির হন মুসা বিন শমসের। বেলা সাড়ে তিনটার পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন ডিবির কর্মকর্তারা।
পরে মুসা বিন শমসেরকে ‘রহস্যময় মানব’ হিসেবে বর্ণনা করেন ডিবির যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশীদ। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘মুসা বিন শমসের বিপুল সম্পদের মালিক হিসেবে দাবি করলেও আদতে তাঁর কোনো সম্পদ নেই। সম্পদের দিক থেকে তিনি একজন অন্তঃসারশূন্য মানুষ, ভুয়া মানুষ। মুসা বিন শমসেরের কিছুই নেই। গুলশানে একটা বাড়ি আছে, সেটিও স্ত্রীর নামে।’
মুসা বিন শমসেরের সঙ্গে ‘প্রতারক’ আবদুল কাদেরের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘মুসা বিন শমসের মুখরোচক অনেক কিছু বলেন। মানুষের সামনে বসলে গল্প বলেন। সেসব গল্প আর মুসা বিন শমসেরের নাম ব্যবহার করে আবদুল কাদের বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এর দায় তিনি (মুসা বিন শমসের) এড়াতে পারেন না। আমি মনে করি, কাদেরের সঙ্গে তাঁর একটা যোগসূত্র আছে। তিনি কাদেরকে বাবু সোনা বলে ডাকেন।’
এসএসসি পাসও করতে না পারা আবদুল কাদেরকে নিজের ‘আইন উপদেষ্টা’ করেছিলেন মুসা বিন শমসের। এর ব্যাখ্যা মুসা বিন শমসেরের কাছে জানতে চেয়েছিলেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
ডিবির যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেন, ‘আমরা তাঁকে (মুসা বিন শমসের) জিজ্ঞাসা করেছি, নবম শ্রেণি পাস মানুষকে আপনি আইন উপদেষ্টা বানালেন কেন? উনি আপনাকে ১০ কোটি টাকার চেক দিলেন, আপনি তাঁকে ২০ কোটি টাকার চেক ফেরত দিলেন। উনি বলেছেন, লাভ দিয়েছেন। কেউ কি এক মাসে ১০ কোটি টাকা বিনিয়োগে ১০ কোটি টাকা লাভ দেয়? এখানে মুসা বিন শমসেরের উদ্দেশ্য কী ছিল, সেটা জানা যায়নি।’
আবদুল কাদেরকে গ্রেপ্তারের সময় তাঁর প্রতিষ্ঠান সততা প্রপার্টিজের অফিস থেকে মুসা বিন শমসের সংশ্লিষ্ট একটি কাগজ পান গোয়েন্দারা। সেখানে উল্লেখ করা হয়, সুইস ব্যাংকে মুসা বিন শমসেরের ৮২ মিলিয়ন ডলার রয়েছে।
ডিবির যুগ্ম কমিশনার বলেন, ‘এ বিষয়ে মুসা বিন শমসেরকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, “ঘটনা সত্য। আমার সুইস ব্যাংকে ৮২ মিলিয়ন ডলার আছে।” আপনি টাকার মালিক, কাগজ কেন কাদেরের কাছে, এ প্রশ্ন করলে নানা গল্প ফাঁদেন মুসা বিন শমসের। বলেন, “আমার একটা কলমের দাম ১০ কোটি টাকা, একটা ঘড়ির দাম ৮ কোটি। জুতার দাম ১০ কোটি টাকা। টাঙ্গাইলে ৩ লাখ একর জমির মালিক। গাজীপুরে ১ হাজার একর জমি রয়েছে।” এসব গল্প মুসা বিন শমসের শিশুসুলভভাবেই হয়তো বলেন।’
হারুন অর রশীদ আরও বলেন, মুসা বিন শমসের বলেছেন, সুইস ব্যাংকের ৮২ মিলিয়ন ডলার পেলে পুলিশকে ৫০০ কোটি টাকা দেবেন। দুদকের ভবন করে দেবেন ২০০ কোটি টাকা খরচ করে।
মুসা বিন শমসের বিশাল গাড়িবহর এবং অস্ত্রধারী দেহরক্ষী নিয়ে চলাচল করেন। তবে ডিবি কার্যালয়ে তিনি সাধারণভাবেই এসেছিলেন। এ প্রসঙ্গে হারুন অর রশীদ বলেন, ‘তাঁকে আগেই বলে দেওয়া হয়েছে ডিবি কার্যালয়ে দেহরক্ষী নিয়ে আসা যাবে না। দেহরক্ষী পালতে যে টাকা লাগে, সেই টাকাও এখন তাঁর নেই।’
তিন ঘণ্টার জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ডিবি কার্যালয় থেকে বেরিয়ে মুসা বিন শমসের সাংবাদিকদের বলেন, ‘আবদুল কাদের একজন প্রতারক। আমিও প্রতারণার শিকার হয়েছি। আমি ভুক্তভোগী হিসেবে কাদেরের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেব। অতিরিক্ত সচিবের ভিজিটিং কার্ড ছাপিয়ে কাদের আমার অফিসে গিয়েছেন। বিভিন্ন সময় ছবি তুলেছেন। মাঝে মাঝে বড় বড় লোকের সঙ্গে কথা বলতেন তিনি। এতে করে আমি বিশ্বাস করি, তিনি একজন অতিরিক্ত সচিব। পরে যখন প্রমাণিত হলো তিনি প্রতারক, তাঁকে বের করে দিই।’
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদ সম্পর্কে মুসা বিন শমসের বলেন, ‘কাদেরের বিষয়েই জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। যা জানতে চেয়েছে, তা আমি বলেছি। ডিবি কর্মকর্তারা সন্তুষ্ট।’
আবদুল কাদেরকে আইন উপদেষ্টা নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে মুসা বিন শমসের বলেন, ‘কাদের মিথ্যা কথা বলেছে। সে আমার সঙ্গে ছবি তুলে প্রতারণা করেছে। কেউ ছবি তুলতে চাইলে তো আমি না করতে পারি না। ছবি নিয়ে প্রতারণা করে, এটার দায়দায়িত্ব তো আমি নিতে পারি না।’