স্টাফ রিপোর্টার, নাটোর : নাটোরের লালপুর উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক খালিদ হোসেন সরল এর হুমকিতে এক কলেজ শিক্ষক গত ১৮ দিন থেকে বাড়িছাড়া রয়েছেন এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ওই শিক্ষক নিজ পরিবার এবং সন্তানাদি রেখে এখন নিজ মালিকানাধীন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রাত্রি যাপন করছেন।
এদিকে তিন সন্তান এবং বৃদ্ধ মাকে নিয়ে চরম নিরাপত্তাহীনতায় দিনাতিপাত করছেন ওই কলেজ শিক্ষকের স্ত্রী এবং একই এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা জান্নাতুল ফেরদৌস বুবলি।
এর আগে পারিবারিক কলহের জেরে গত ২৭এপ্রিল মধ্যরাতে ওই শিক্ষকের উপর হামলা ও মারপিটে আহত করে যুবলীগ নেতা ও তার অনুসারীরা।
ওই পরিবারের দাবি, ওই ঘটনায় থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েও কোন প্রতিকার পাননি। উপরন্ত ওই শিক্ষকের হামলা থেকে বাঁচতে মিথ্যা মামলা করেছে ওই যুবলীগ নেতা।
ওই যুবলীগ নেতার নাম খালিদ হোসেন সরল। তিনি উপজেলার রামকৃষ্ণপুর গ্রামের জাহাঙ্গীর হোসেন ও লতিফা হোসেন বেলির দ্বিতীয় সন্তান। বর্তমানে তিনি লালপুর ত্রিমোহিনীর দেওয়ান মার্কেট এলাকায় বসবাস করছেন।
তথ্য মতে, সরলরা দুই ভাই আর এক বোন। বড় ভাই সম্রাট ঢাকায় একটি কোম্পানিতে চাকরি করেন। ছোট বোন জান্নাতুল ফেরদৌস বুবলি লালপুর কে এন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা। ভুক্তভোগী ওই শিক্ষকের নাম সুলতানুজ্জামান টিপু। তিনি লালপুর উপজেলার মোহরকয়া ডিগ্রী পাস ও অনার্স কলেজের পদার্থ বিজ্ঞানের বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান।
লালপুর গ্রীনভ্যালি পার্কের পরিচালক, লালপুর প্রাকৃীতি ফাউন্ডেশনের স্বাস্থ্য বিষয়ক পরিচালক এবং বুবলির স্বামী ও অভিযুক্তের ভগ্নিপতি।
লালপুর হাসপাতাল গেটে টিপুর মালিকানাধীন পদ্মা ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং পদ্মা জেনারেল হাসপাতাল নামে দুইটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ওই প্রতিষ্ঠানে গত ১৪ দিন থেকে রাত্রি যাপন করছেন টিপু।
জানা যায়, উপজেলার রামকৃষ্ণপুর গ্রামে সরলের বাবা জাহাঙ্গীর হোসেন ও মা লতিফা হোসেনের দেড় বিঘা বসত বাড়িসহ প্রায় ২০ বিঘা জমি রয়েছে। এ সমস্ত জমি জমা বাবার মৃত্যুর পর সরল একা ভোগ দখল করেন। এর পাশাপাশি লালপুর ত্রিমোহিনী এলাকায় জাহাঙ্গীর হোসেন চার শতক জমিতে দ্বিতল মার্কেট ভবন নির্মাণ করেন। একই দাগে আরও ২ শতক জমি প্রায় ৩০-৪০ বছর আগে বায়নানামা করলেও মামলা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে রেজিস্ট্রি করেননি। পাশে আরো একটি দাগে আড়াই শতক জমিতে তার আরো একটি তিন তলা ভবন রয়েছে, যার প্রথম ও দ্বিতীয় তলা মার্কেট এবং তৃতীয় তালায় বসবাসের জন্য ফ্ল্যাট রয়েছে। সরলের বড় ভাই চাকরির কারণে ঢাকায় বসবাস করেন। সরল নিজ পছন্দে বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করার পর স্ত্রী আন্না রহমান অরিনকে নিয়ে বাবা মার সাথে রামকৃষ্ণপুর এ একসাথে থাকতেন।কিন্তু সরলের পাশাপাশি সরলের বউয়ের কথা, কাজে এবং অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ২০১৭ সালে জাহাঙ্গীর হোসেন ও লতিফা হোসেন লালপুর ত্রিমোহীনের আড়াই শতকের উপর নির্মিত তিন তলা ফ্লাটে থাকতে শুরু করেন। একপর্যায়ে স্বামী-স্ত্রী হজ্জ করার সিদ্ধান্ত নেন, হজ্জে যাওয়ার আগে পাশের ৪ শতকের ওপর নির্মিত দুই তলা মার্কেট সহ চার শতক জমি স্ত্রী লতিফা হোসেন বেলীকে রেজিস্ট্রি করে দেন। ২০১৯ সালে হজ্জে গিয়ে জাহাঙ্গীর হোসেন মারা যান। ৪২ দিন স্বামী ছাড়া একা হজ্জ করে লতিফা হোসেন দেশে ফেরেন।
এদিকে হজ্জে বাবা মারা যাওয়ার খবর পেয়ে সরল ও তার স্ত্রী ওই আড়াই শতকের ওপর নির্মিত সরলের বাবা মার বসবাসরত ফ্ল্যাটটি গ্রামের বাড়ি থেকে এসে দখল করেন। হজ্জ থেকে ফিরে লতিফা হোসেনও একই প্ল্যাটে ওঠেন। কিছুদিন পর ছেলে ও ছেলের বউয়ের সাথে বনিবনা না হওয়া এবং তাদের ভৎসনা, অবজ্ঞা সহ্য করতে না পেরে পারিবারিং মিটিং করা হয়। সেই মিটিংয়ে বড় ভাই সম্রাটকে মারপিট করে সরল। পরে ওই বাড়ি থেকেও বের হতে হয় মা-কে।
এদিকে সরলের বাবার বায়না করা ২শতক জমিটির সুরাহার জন্য জামাই টিপুর কাছ থেকে ১৭ লক্ষ টাকা নিয়ে ওই দুই শতক জমি নিজ নামে রেজিস্ট্রি করেন লতিফা হোসেন। পাশাপাশি লতিফা হোসেনের কথায়
পাশের ৪ শত জমির ওপর নির্মিত দুইতলা মার্কেটের ওপরে টিপু এবং বুবলি তাদের বেতনের এগনেস্টে সোনালী ব্যাংক থেকে ঋণ করে ২৫ লক্ষ টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট নির্মাণ করে বুবলির মা সহ ওই ফ্ল্যাটে বসবাস করতে থাকেন। পরবর্তীতে বুবলিকে তার মা দশমিক দুই পাচ শতক জমিসহ তৃতীয় তলার এই ফ্ল্যাট টি রেজিস্ট্রি করে দেন।
কিছুদিন পর সরল মায়ের নামে থাকা ৬ শতক জমির উপর নির্মিত ফ্ল্যাটের দোতলার পুরো মার্কেটটি দখল করে নেন। পাশাপাশি মা সহ বসবাসরত ফ্লাট থেকে বুবলি এবং টিপুকে চলে যেতে হুমকি ধামকি দিতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৭ এপ্রিল রাতে নিজ ডায়গনস্টিক সেন্টার থেকে বাসায় ফেরার পথে টিপুকে সরল ও তার অনুসারিরা অতর্কিত হামলা করে মারপিট করে। ওই সময় তাকে বাঁচাতে এলে মারপিটে বুবলিও আহত হন।
বুবলির দাবী, ঘটনার পর ওই রাত্রেই থানায় অভিযোগ দেন তিনি। ওদিকে ওই ঘটনার পর দীর্ঘ কয়েক দিন রাজশাহীতে চিকিৎসা নিয়ে ফিরলেও তাকে নিজের স্ত্রীর নামের ওই ফ্ল্যাটে যেতে দিচ্ছে না সরল। ওই ফ্লাটে গেলে তাকে মারপিট ও হত্যা করার হুমকি দেয়া হচ্ছে।
বুবলি আরও জানান, টিপুকে মারপিটের পরের দিন ২৮শে এপ্রিল রাতে বুবলির বাড়ির সামনের দুইটি সিসি টিভি ক্যামেরা ভাঙচুর করে সরলের স্ত্রী অরিন।
টিপু জানান, সম্প্রতি বাড়ির কাছে গেলে সরল তার অনুসারী ক্যাডার পাঠায়, প্রাণভয়ে তিনি আবার তার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চলে আসেন। সরলদের ভয়ে তিনি এখনও বাড়ি ছাড়া হয়ে ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রাত্রি যাপন করছেন।
টিপু আরো জানান, এই ঘটনার পর বুবলি থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েও কোন প্রতিকার পাননি। উপরন্ত সরল থানায় গিয়ে নিজ স্ত্রীকে ব্যবহার করে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দিয়েছে।
বুবলি ও সরলের মা লতিফা হোসেন জানান, তার ছেলে আর ছেলের বউয়ের অত্যাচারে তিনি পরপর দুইটি বাড়ি, আবাদী জমি ছেড়ে মেয়ের কাছে আশ্রয় নিয়েছেন। মেয়েকে নিজ নামের জমির উপর মেয়ের তৈরি করা তৃতীয় তলা ফ্লাটটি কোয়ার্টার শতক জমি সহ রেজিস্ট্রি করে দিয়েছেন। সরল এখন মেয়ের নামের রেজিস্ট্রি কৃত ফ্লাটটি এবং তার নামে থাকা ৬ শতকের মার্কেটটি দখল নিতে তাকে, তার মেয়ে, জামাই, নাতি নাতনিদের বিতাড়িত করতে মারপিট হুমকি ধামকি চালাচ্ছে। তিনি অবিলম্বে সরলের ও সরলের বইয়ের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, সমস্যার সমাধান, নিরাপত্তা এবং জামাই টিপুকে বাসায় ফিরতে পুলিশ প্রশাসন ও প্রধানমন্ত্রী হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সরল জানান, টিপুর চরিত্র খারাপ। টিপু তার স্ত্রীর হাত ধরেছিল। তার বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে সরল জানান, এটা তাদের পারিবারিক ব্যাপার, পারিবারিকভাবে মীমাংস হবে।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে লালপুর থানার ওসি নাসিম আহমেদ জানান, উভয় পক্ষ থানায় অভিযোগ দিয়েছে, তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে।