নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রধান প্রকৌশলী (বাস্তবায়ন) উজ্জল মল্লিকের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, সরকারি অর্থের লাগামহীন অপচয়, অনিয়ম-দুর্নীতি ও কমিশন বাণিজ্যের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। এসব অভিযোগের বিষয়ে তিন সদস্য বিশিষ্ট অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অনুসন্ধান কমিটির সদস্যরা হলেন- সহকারী পরিচালক প্রবীর কুমার দাস এবং মো. সহিদুর রহমান ও আফনান জান্নাত কেয়াসহ তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠনপূর্বক অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে। গত ১৬ এপ্রিল দুদকের সহকারী পরিচালক ও অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা আফনান জান্নাত কেয়া স্বাক্ষরিত স্মারক নং-০০.০১.০০০০.৫০১.০১.১৩০.১৮/
রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী (বাস্তবায়ন) উজ্জল মল্লিক পূর্বাচল প্রকল্পে কর্মরত থাকাকালীন লেক, মাটি ভরাট, ঊর্ধ্ব রাস্তা নির্মাণ এবং ঊর্ধ্ব ড্রেন নির্মাণ সংক্রান্ত নথির সত্যায়িত ফটোকপি এবং ৫নং সেক্টরের লেক ভরাট সংক্রান্ত রেকর্ডপত্রের সত্যায়িত ফটোকপি চাওয়া হয়েছে। এছাড়া পূর্বাচল প্রকল্পের ওয়াটার সাপ্লাই এর বরাদ্দ ও ব্যয় সংক্রান্ত নথির সত্যায়িত ফটোকপি এবং পূর্বাচল প্রকল্পের লে-আউট কতবার সংশোধন করা হয়েছে, সে সংক্রান্ত রেকর্ডপত্রের সত্যায়িত ফটোকপিসহ বিস্তারিত ওয়েষ্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং হতে ডিপিএম পদ্ধতিতে মালামাল ক্রয়ের সকল অর্ডার, বিল পরিশোধ সংক্রান্ত বিল ভাউচার চাওয়া হয়েছে। আর এ বিষয়ে কোন তদন্ত সংগঠিত হয়েছে কি-না, সে সংক্রান্ত রেকর্ডপত্র ও তদন্ত প্রতিবেদন এবং পূর্বাচল প্রকল্পে শিকদার গ্রুপের অনুকূলে বরাদ্দকৃত প্লট সংক্রান্ত নথি ও রেকর্ডপত্রের সত্যায়িত ফটোকপি ওই পত্রের মাধ্যমে চাওয়া হয়েছে। তারা প্রধান প্রকৌশলী উজ্জল মল্লিক এর নামে পূর্বাচল প্রকল্প হতে কতটি প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন এবং প্লট বরাদ্দ সংক্রান্ত সকল নথি পত্ৰ চাওয়া হয়েছে। তাছাড়া রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) কর্তৃক পূর্বাচল প্রকল্পের ১৫০০ ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে প্লট বরাদ্দ সংক্রান্ত নথিপত্র চাওয়া হয়েছে। জানা গেছে, রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী উজ্জল মল্লিকের দুর্নীতি ও অনিয়মের সীমা নেই। তিনি নির্দ্বিধায় তার থেকে অভিজ্ঞ সিনিয়র ৪ থেকে ৫জনকে ডিঙ্গিয়ে রাজউক এর প্রকৌশল শাখার আকর্ষণীয় পদ, প্রধান প্রকৌশলী (বাস্তবায়ন) পদে অধিষ্ঠিত হন। এই পদটি পেতে একজন প্রতিমন্ত্রীসহ বিভিন্ন স্তরে কয়েক কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়েছে বলে রাজউকের নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মচারীরা জানিয়েছে। শুধু তাই নয়, এই নোটিশের বিষয়টি নিয়ে এখন কর্মচারী-কর্মকর্তাদের মুখে মুখে আলোচনা চলছে। তারা বলছেন, রাজউকের প্রকৌশলী আব্দুল লতিফ হেলালীকে উক্ত পদে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশক্রমে পদায়ন করা হয়েছিল। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের সেই নির্দেশ উপেক্ষা করে রাজউক এর সাবেক চেয়ারম্যান সাইদ নুর আলম মোটা অংকের উৎকোচের বিনিময়ে হেলালীকে সরিয়ে উজ্জল মল্লিককে পদায়ন করা হয়। সুচতুর প্রকৌশলী উজ্জল মল্লিক এর জাদুকরী গুণের মধ্যে এটি অন্যতম নিদর্শন বলে জানা গেছে। অনিয়মতান্ত্রিক ভাবে অধিষ্ঠিত প্রধান প্রকৌশলী হওয়ার পর উজ্জল মল্লিক রাজউক এর প্রকৌশলীদের মধ্যে গ্রুপিং সৃষ্টি করেন। আর উজ্জল মল্লিকের কথার বাইরে কেউ যাতে যেতে না পারেন, সে জন্য তার নিয়ন্ত্রণাধীন সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে সিনিয়র প্রকৌশলীদেরকে হেনস্থা করা হয়। বেশ কিছুদিন আগে উজ্জল মল্লিকের চেয়ে সিনিয়র প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম এর রুমে সন্ত্রাসী পাঠিয়ে টেবিল চেয়ার ভাংচুর ও জামায়াত সমর্থক আখ্যা দিয়ে গালিগালাজ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, নুরুল ইসলাম এর গায়ে হাত পর্যন্ত তোলা হয়েছে বলেও নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজউকের একাধিক কর্মচারী জানিয়েছেন। আর উজ্জল মল্লিকের লেলিয়ে দেওয়া সন্ত্রাসীরা গত ২০২১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাহাত মুসলেমীন নামে একজন প্রকল্প পরিচালককে বিএনপির সমর্থক আখ্যা দিয়ে তার অফিস কক্ষে ভাংচুর করা হয়। অফিসারদের গায়ে হাত দেওয়া এমনকি একজন মহিলা প্রকল্প পরিচালককেও লাঞ্ছিত করার অভিযোগ রয়েছে। প্রধান প্রকৌশলী (বাস্তবায়ন) উজ্জল মল্লিকের কথা কেউ যদি না শোনেন, তাহলে তাদেরকে রাজউক থেকে তাড়ানোর হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। সূত্র জানায়, রাজউক এর সাবেক প্রধান প্রকৌশলী এমদাদুর ইসলাম (বিএনপির সাবেক মন্ত্রী নোমান এর (জামাতা)। তার হাত ধরেই উজ্জল মল্লিক রাজউকে চাকরি হয়। বিএনপির অপর এক নেতার ভ্রাতুষ্পুত্রের নিয়োগের সময় সহকারী প্রকৌশলী পদ খালি না থাকায়, প্রভাব খাটিয়ে কম্পিউটার অপারেটর হিসাবে মাস্টার রোল-এ যোগদান করেন। এরপর ১ম শ্রেণীর কর্মকর্তাদের নিয়োগে সরকারী চাকুরি বিধান লঙ্ঘন করে তৎকালীন সরকারের দুর্নীতিবাজ গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী তাকে রাজউক-এ সহকারী প্রকৌশলী পদে অস্থায়ী হিসেবে নিয়োগ দেন। এরপর রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় চাকরি হওয়ায় তৎকালীন মন্ত্রীর পৃষ্ঠপোষকতায় উজ্জল মল্লিক বহাল থেকে যান।
অপরদিকে গত ২০০৮ আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর উজ্জল মল্লিক রাতের আঁধারে ভোল পাল্টান। চিটাগং থেকে নির্বাচিত ফজলে করিম চৌধুরী এর নাম ভাঙ্গিয়ে তিনি পদ মর্যাদা বাড়িয়ে নেয়। এরপর ইঞ্জিনিয়ার মোশারফ হোসেন (চট্টগ্রাম) মন্ত্রী হওয়ার পর উজ্জল মল্লিক-এর স্বেচ্ছাচারিতা বৃদ্ধি পান। তারই ধারাবাহিকতায় সিনিয়রদের ডিঙ্গিয়ে পদন্নোতি নিয়েছেন তিনি। বিএনপির ছত্রছায়ায় নিয়োগ ও অনৈতিক সুবিধাপুষ্ট উজ্জল মল্লিক খোলস পাল্টে চিটাগাং-এর জন্মপরিচয় ব্যবহার করে অদ্যবধি প্রভাব খাটিয়ে আসছেন। তার দুর্নীতি আর ক্ষমতার অপব্যবহারের সীমা নেই।
সূত্র জানায়, গত ২০০৭-২০০৮ সালে তেজগাঁও রেলক্রসিং বিজয় সরণির ওভারপাস নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প ব্যবস্থাপক ছিলেন প্রকৌশলী উজ্জল মল্লিক। তখন র্যাংগস ভবন ভাঙ্গা ও অপসারণের সময় একই এলাকার ঠিকাদার এর সাথে যোগসাজশে চরম অব্যবস্থাপণার সৃষ্টি করে। ফলে সেখানে ১৩ জন নিরীহ শ্রমিক এর অপমৃতুর ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনার জন্য প্রকৌশলী উজ্জল মল্লিককে দায়ী করেন শ্রমিকরা। আর র্যাংগস বিল্ডিং এর মালিক ওই ঘটনার পর একটি মামলাও করেন। বৃহৎ অবকাঠামো অপসারণের কাজে যোগ্য ও অভিজ্ঞ পরামর্শকের প্রয়োজন থাকলে তা তিনি গ্রহণ করেননি। তারপরও তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক এর ছত্রছায়ায় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে দিক-নির্দেশনা দিতে এককভাবে উজ্জল মল্লিক দায়িত্ব নিয়েছিলেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। র্যাংগস ভবনের বর্জ্যের ভার বহন করতে না পারায় ভবনের ছাদগুলি একসাথে ভেঙ্গে পড়ে। ফলে সেখানে ১৩ জন শ্রমিক মারা যান। কিন্তু ওই ঘটনায় উজ্জল মল্লিক রেহাই পেয়ে যান।
শুধু তাই নয়, প্রকৌশলী উজ্জল মল্লিক নিজের দুর্নীতি আড়াল করতেও দুর্নীতির আশ্রয় নেন। তার মধ্যে ঠিকাদারী কাজের টেন্ডার ডকুমেন্ট-এ কারসাজি করে কোটি কোটি টাকা ভাগিয়ে নিয়েছেন প্রকৌশলী উজ্জল মল্লিক। আবার একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ১২০০ কোটি টাকা মূল্যের কাজ দেওয়ার বিনিময়ে একজন মন্ত্রী ও তৎকালীন রাজউক চেয়ারম্যানের ডান হাত হিসেবে পরিচিত উজ্জল মল্লিক কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া, পূর্বাচল প্রকল্পের ওয়াটার সাপ্লাই কাজের (পিপিপি) http://www.pppo.gov.bd/ খাত থেকেও উজ্জল মল্লিক কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। আবার টেন্ডার ডকুমেন্ট-এ তথ্যের ঘাপলা করে অনৈতিকভাবে অযোগ্য ঠিকাদারগণকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার মাধ্যমে তিনি কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। উদাহরণ স্বরূপ, প্যাকেট নম্বর ১৯আরসি, ০৬ ও জি-লট নম্বর, ০১.০২.০৩.০৪ সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রথমবার দরপত্র মূল্যায়ক কমিটির সিদ্ধান্ত আমূল পাল্টে দ্বিতীয়বারের (টি.ই.সি)-এর মাধ্যমে পছন্দ মত ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দিয়েও প্রায় দুই কোটি হাতিয়ে নিয়েছেন।
অপর এক ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের শত কোটি টাকার রাস্তার কার্পেটিন কাজে ঘষা-মাজা করে উজ্জল মল্লিক প্রায় ১৭ কোটি টাকা ভাগিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। আর হঠাৎ করেই রাজউক-এর প্রধান প্রকৌশলীর পদে দায়িত্ব পান। তিনি নিয়োগ বিধি মতে উক্ত পদোন্নতি প্রাপ্তির জন্য “তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদে ন্যূনতম ৫ বছর চাকুরিরত থাকা প্রয়োজন। কিন্তু উজ্জল মল্লিক এর সিনিয়র একাধিক কর্মকর্তার অনুরূপ কর্মকাল বিদ্যমান। তারপরও উজ্জল মল্লিক এর অভিজ্ঞতা প্রয়োজন হয়নি। আর পূর্বাচল প্রকল্পে মাত্র ৩ কাঠার প্লট বরাদ্দ পেয়ে তিনি প্রভাব খাটিয়ে তার পরিবর্তন করে ৮.৫০ কাঠার প্লটে রূপান্তরিত করেছেন। তিনি রাজউকের বনানী নিবাসস্থ কোয়ার্টারে থাকলেও সেখানে বিশাল বাংলো বানিয়ে অবকাশ যাপন করছেন। তার বিরুদ্ধে দেশের বাইরে অর্থ পাচারের অভিযোগ রাজউকের একাধিক সূত্র দৈনিক জাতীয় অর্থনীতিকে জানিয়েছে।
উল্লেখিত অভিযোগ ও দুদকের নোটিশের বিষয়ে জানতে রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী (বাস্তবায়ন) উজ্জল মল্লিকের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি কল ধড়েন নি। এবং তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।