ঢাকায় ২০টি সরকারিসহ ২৩টি প্লট ও সাত ভবনের মালিক মনির হোসেন ওরফে গোল্ডেন মনির। ব্যাংকে তাঁর রয়েছে ৭৯১ কোটি টাকা। ঢাকায় রয়েছে একটি আবাসন প্রতিষ্ঠান ও দুটি গাড়ির শোরুম। ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জে তিনি আরও এক একর জমির মালিক।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অনুসন্ধানে মনির হোসেনের এত সব সম্পদের তথ্য বেরিয়ে এসেছে। সিআইডির পরিদর্শক মো. ইব্রাহিম হোসেন গত জানুয়ারি থেকে পাঁচ মাস এ বিষয়ে অনুসন্ধান করেছেন। সিআইডি বলছে, মনিরের সব সম্পদই অপরাধের মাধ্যমে অর্জিত। গত বছরের ২০ নভেম্বর রাজধানীর মেরুল বাড্ডার বাসায় অভিযান চালিয়ে মনিরকে মাদক ও অস্ত্রসহ আটক করে র্যাব। গ্রেপ্তারের পর তাঁর বিরুদ্ধে বাড্ডা থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা হয়। এ ছাড়া মতিঝিল ও রমনা থানায় মাদকদ্রব্য ও দুদক আইনে আরও চারটি মামলা রয়েছে। মনির হোসেন বর্তমানে কারাগারে আছেন।
সিআইডির কর্মকর্তারা বলেন, গোল্ডেন মনির সোনা চোরাচালান, জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ভূমি দখল ও ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজি করে এসব অর্থসম্পদের মালিক হয়েছেন। পরে তিনি ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনের একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও সিরাজগঞ্জ আওয়ামী লীগের একজন নেতাসহ সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের সদস্যদের সহযোগিতায় বিভিন্ন ব্যবসায় বিনিয়োগ ও নিজ স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংকে লেনদেন ও স্থানান্তরের মাধ্যমে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মালিক হন।
সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মোহাম্মদ আবদুল্লাহেল বাকী গতকাল রোববার জাতীয় অর্থনীতিকে বলেন, গোল্ডেন মনির ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে অপরাধলব্ধ আয়ে করা অস্থাবর ও স্থাবর সম্পদের তথ্য–প্রমাণ পেয়েছেন তাঁরা। মনিরের বিরুদ্ধে বাড্ডা থানায় মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা করতে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
সিআইডি সূত্র জানায়, গোল্ডেন মনিরের প্রধান সহযোগী সিরাজগঞ্জের জেলা আওয়ামী লীগের একজন নেতা, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে এজাহার প্রস্তুত করা হয়েছে। এতে মনিরের স্ত্রী, ছেলে, দুই বোন ও ভগ্নিপতিকে আসামি করা হয়েছে। দু-এক দিনের মধ্যে তাঁদের বিরুদ্ধে বাড্ডা থানায় মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা করা হবে।
সিআইডি সূত্র জানায়, অপরাধলব্ধ আয় দিয়ে গোল্ডেন মনির উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের সোনারগাঁও জনপথ রোডে গ্র্যান্ড জমজম টাওয়ার এবং উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের সাফা টাওয়ারের অন্যতম মালিক হন। ঢাকায় তাঁর ৯০ কাঠার বিভিন্ন আয়তনের প্লট রয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে বাড্ডায় রাজউকের (রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) আড়াই কাঠার ১৯টি প্লট, রাজউক পূর্বাচলে ১০ কাঠার একটি প্লট, বারিধারা জে ব্লকে সাড়ে আট কাঠা করে দুটি প্লট, খিলক্ষেতে পৌনে দুই কাঠার একটি প্লট, তুরাগের নলভোগ মৌজায় ১২ কাঠা জমি। এ ছাড়া গোল্ডেন মনিরের নামে ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের চর রুহিতপুরে আড়াই বিঘা জমি রয়েছে। আবাসন প্রতিষ্ঠান স্বদেশ প্রপার্টিজে (বাড্ডা) তাঁর মালিকানা রয়েছে।
সিআইডি বলেছে, গোল্ডেন মনিরের নামে ১২৯টি ব্যাংক হিসাবে ৭৯১ কোটি ৫ লাখ ৯৬ হাজার ৫২৩ টাকা পাওয়া গেছে। তিনি এই আয়ের একটি অংশ সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের সদস্যদের পরস্পর যোগসাজশে যৌথ ও একক নামে ব্যবসায় বিনিয়োগ করে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিতে রূপান্তর করেছেন। তাঁর মালিকানাধীন অটো কার সিলেকশন লিমিটেডের হিসাব থেকে রাজউক কর্মচারী বহুমুখী কল্যাণ সমিতির হিসাবে পাঁচ কোটি টাকা পাঠানোর তথ্য পাওয়া গেছে, যা সন্দেহজনক।
বাড্ডার ডিআইটি প্রকল্পে আড়াই কাঠা করে পাঁচটি প্লটে পাঁচটি ভবন নির্মাণ করে গোল্ডেন মনিরের স্ত্রী রওশন আরা তা ভোগদখল করছেন। অপরাধলব্ধ আয় দিয়ে গোল্ডেন মনির তাঁর ছেলে রাফি হোসেনকে (২৪) কার অটো সেন্টারের মালিকানা দিয়েছেন। রাফি স্নাতক সম্মান শ্রেণিতে পড়েন।
মনির হোসেনের দুই বোন ও দুই ভগ্নিপতি রাজউকের প্লটগুলো দেখাশোনা ও ভোগদখল করে আসছিলেন। সিআইডি জানায়, ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনের একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর গোল্ডেন মনিরের অপরাধ কর্মকাণ্ডের সহযোগী। ওই ওয়ার্ড কাউন্সিলর ঢাকায় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পার্কিং ইজারা নিয়ে মনির হোসেনের সোনা চোরাচালানে সহযোগিতা করেছেন। সোনা চোরাচালানে অবৈধ আয় দিয়েই গোল্ডেন মনির ও তাঁর সহযোগীরা উত্তরায় ১৪ তলা জমজম টাওয়ার নির্মাণ করেছেন, যার একাংশের মালিক ওই ওয়ার্ড কাউন্সিলর। মাদক ও চাঁদাবাজিতে জড়িত থাকার অভিযোগে তাঁর নামে রাজধানীর উত্তরখান ও দক্ষিণখান থানায় তিনটি মামলা রয়েছে।
গোল্ডেন মনিরের অপরাধ কর্মকাণ্ডের আরেক সহযোগী সিরাজগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা। ১৯৯৬ সালে সোনালী ব্যাংকের এয়ারপোর্ট শাখায় পিয়ন পদে চাকরি করার সময় গোল্ডেন মনিরের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয় এবং সোনা চোরাচালানে জড়িয়ে পড়েন। পরে চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। অপরাধলব্ধ আয় দিয়ে তিনি বহুতল জমজম ও আল সাফা টাওয়ারের অন্যতম মালিক হন