ঝিনাইদহ-৪ আসনের সরকারদলীয় এমপি আনোয়ারুল আজিম হত্যাকান্ডে রিমান্ডে মুখ খুলতে শুরু করেছে খুনিরা। বেরিয়ে আসছে রহস্যময় নাম। রাজনীতিবিদ থেকে প্রভাবশালী, বাদ যাচ্ছেন না যেন কেউই। তবে এরা আদৌ জড়িত কি না, তাতে গোয়েন্দাদের সন্দেহ রয়েছে। এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকান্ডে তাদের জড়িত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত না হয়ে এখনই কিছু বলতে চাইছেন না গোয়েন্দাকর্তারা।
তবে ভয়ংকর এ ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে চিহ্নিত যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী আক্তারুজ্জামান শাহিনকে আইনের আওতায় আনতে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা-ইন্টারপোলের সহায়তা চাইবে পুলিশ। পুলিশ বলছে, মাস্টারমাইন্ড শাহিনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা গেলে অনেক প্রশ্নের উত্তর বেরিয়ে আসবে। অন্যদিকে, চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার তদন্তে শিগগিরই কলকাতা যাবে গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল।
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান গতকাল বলেছেন, তদন্তে এখন পর্যন্ত উঠে এসেছে ষড়যন্ত্রকারী একজনের নাম। বাকিরা সব ভাড়াটে। ঘটনার মোটিভ সম্পর্কে জানতে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। দু-এক দিনের মধ্যেই আমরা তাকে আইনের আওতায় আনতে ইন্টারপোলের সহায়তা চাইব।
এক প্রশ্নের জবাবে ডিএমপি কমিশনার বলেন, বাংলাদেশ এবং ভারতের পুলিশ এ ঘটনার তদন্ত করছে। লাশ উদ্ধারের জন্য তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। শিগগিরই আমাদের তিন সদস্যের একটি দল ভারতে যাবে। এমপি আনার হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার তিন আসামির আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। তারা হলেন সৈয়দ আমানুল্লাহ আমান ওরফে শিমুল ভূঁইয়া, তানভীর ভূঁইয়া ও শিলাস্তি রহমান।
গতকাল তাদের আদালতে হাজির করে পুলিশ। এরপর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের ওয়ারী জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার মাহফুজুল ইসলাম তাদের ১০ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন। শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট দিলরুবা আফরোজ তিথির আদালত এ আদেশ দেন। এর আগে দুই দিন টানা জিজ্ঞাসাবাদ শেষে গত বৃহস্পতিবার এ তিনজনকে গ্রেফতার দেখায় পুলিশ।
‘কোনোভাবেই যেন কাজটা মিস না হয় এবং কোনো প্রমাণ না থাকে’-আনারকে হত্যার মিশন সম্পন্ন করতে এমন নির্দেশনা দিয়েছেন তার বন্ধু আক্তারুজ্জামান শাহিন। হত্যাকান্ডের ঘটনায় গ্রেফতার আসামিরা জিজ্ঞাসাবাদে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে এ তথ্য দিয়েছেন। নির্দেশনা পেয়ে তারা সুচারুভাবে পুরো ঘটনাটি সম্পন্ন করতে পারলেও পুলিশের তৎপরতায় তাদের শেষরক্ষা হয়নি।
তদন্তসংশ্লিষ্ট এক সূত্র বলছেন, এখন পর্যন্ত সোনার কারবার নিয়ে এমপি আনারের সঙ্গে আক্তারুজ্জামান শাহিনের বিরোধের বিষয়টি উঠে আসছে। ওই বিরোধে ঘি ঢেলেছেন আরও অনেকেই। কারণ, আনারের কাছে পাওনা মোটা অঙ্কের অর্থ কোনোভাবেই আদায় করতে পারছিলেন না শাহিন। সীমান্তবর্তী এলাকার এমপি হওয়ায় সোনা চোরাচালানে কোনোভাবেই আনারকে এড়িয়ে যেতেও পারছিলেন না তিনি। তবে আনারের সঙ্গে রাজনৈতিক এবং ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব ছিল এমন কিছু রহস্যময় নাম উঠে আসছে। এরই মধ্যে এ বিষয়টি নিয়ে নিহতের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও কয়েক দফা কথা বলেছেন সংশ্লিষ্টরা। সন্দিগ্ধ ব্যক্তিদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। তবে নিশ্চিত না হয়ে এখনই তাদের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কিছু বলতে চাচ্ছেন না তারা। এ ছাড়া ভারতীয় পুলিশের দুই সদস্যের প্রতিনিধি শশী সরকার ও ভেঙ্কাটা ভাটাহ ভার্মা গতকাল পর্যন্ত গ্রেফতারকৃতদের সঙ্গে কয়েক দফা কথা বলেছেন। ২৩ মে তারা ঢাকায় আসেন।
ডিবিসূত্রে জানা গেছে, জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার আসামিরা জানিয়েছেন, হত্যাকান্ডের মূল পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান শাহিনের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে ভুক্তভোগী এমপি আনোয়ারুল আজিম আনারের সোনার ব্যবসায়িক লেনদেনের সম্পর্ক রয়েছে। লেনদেনসহ আরও কিছু স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আনোয়ারুল আজিমের ওপর আক্তারুজ্জামান শাহিনের ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। এ বিষয়টি বুঝতে পারেননি আনোয়ারুল আজিম।
ভারতীয় পুলিশের (সিআইডি) কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের বরাত দিয়ে তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, কলকাতায় গ্রেফতার জিহাদ হাওলাদার ওরফে কসাই জিহাদ এমপি আনার হত্যার বীভৎস বর্ণনা দিয়েছেন। লাশের খন্ডিতাংশ উদ্ধারের জন্য তাকে নিয়ে গতকাল দিনভর অভিযান চালিয়েছে সিআইডি। কারণ, সিআইডির কাছে তিনি স্বীকার করেছেন, কলকাতার বটতলার পাশের হাতিশালা বর্জ্যখালে ফেলা হয়েছিল লাশের কিছু খন্ডিতাংশ। যদিও গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনো কিছুই উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। আদালতের নির্দেশে জিহাদকে ১২ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে কলকাতা সিআইডি। সূত্র আরও বলছেন, এমপি আনারকে হত্যা এবং লাশ গুম করতে দীর্ঘদিন ধরে পরিকল্পনা করেছিলেন সৈয়দ আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়া। দুটি হত্যা মামলায় দুই দফায় ২০ বছর জেল খাটা আমানুল্লাহ পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্র্টির দুর্ধর্ষ ক্যাডার। তারই পরামর্শে হত্যা এবং লাশ গুম নিখুঁত করতে দুই মাস আগেই মুম্বাই থেকে উড়িয়ে আনা হয় কসাই জিহাদকে। তাকে দেওয়া হয় মোটা অঙ্কের অর্থ।
সিটিটিভি ফুটেজে যা দেখা গেল : এমপি আনারকে কলকাতার নিউটাউনের ফ্ল্যাটে হত্যা করা হয়েছে, সেখানকার একটি সিসিটিভি ফুটেজ প্রকাশ করেছে পুলিশ। তাতে দেখা যায়, ১৪ মে ভোর ৫টা ৫ সেকেন্ডে ফ্ল্যাটের দরজা দিয়ে বের হচ্ছেন দুজন। তাদের একজনের হাতে একটি হালকা সবুজ রঙের ট্রলিব্যাগ। আরেকজনের হাতে কয়েকটি পলিথিন ব্যাগ। তারা লিফটে উঠছিলেন।
পুলিশ বলছে, ১৩ মে কলকাতার নিউটাউনের অ্যাকুইটিকা একটি ট্রিপ্লেক্স বাড়িতে এমপি আনারকে হত্যা করা হয়। ওই বাড়ির মালিক রাজ্য শুল্ক বিভাগের কর্মচারী সঞ্জীব ঘোষ। তিনি বাংলাদেশি বংশোভূত মার্কিন নাগরিক আক্তারুজ্জামান শাহিনের কাছে বাড়িটি ভাড়া দিয়েছেন। সে বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে রক্তের দাগ ছাড়া আর কিছু পায়নি পুলিশ। পরে জানা যায়, তাঁর মৃতদেহ টুকরো টুকরো করে এবং হাড় ও মাংস বিচ্ছিন্ন করে বাইরে ফেলে দেওয়া হয়। আনোয়ারুল আজিম আনারকে হত্যার জন্য ভারতের মুম্বাই থেকে ‘কসাই’ জিহাদ হাওলাদারকে কলকাতায় আনা হয়। তাকে গত বৃহস্পতিবার গ্রেফতারের পর গতকাল ১২ দিনের রিমান্ডে পেয়েছে পুলিশ। আনারকে হত্যার পর কীভাবে তাঁর লাশ টুকরো টুকরো করা হয় এরই মধ্যে এর রোমহর্ষক বর্ণনা মিলেছে।
তাকে জিজ্ঞাসাবাদের পর বৃহস্পতিবার রাত থেকে কলকাতা পুলিশ এলাকার পোলেরহাট থানার কৃষ্ণবাটি সেতুর কাছে বাগজোলা খালে তল্লাশি চালায়। নিউটাউন এলাকার যে ফ্ল্যাটে আনারকে খুন করা হয়, তার সামনে দিয়েই বয়ে গেছে এ খাল। তবে গতকাল রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত লাশের কোনো সন্ধান মেলেনি।
প্রসঙ্গত, নিখোঁজ হওয়ার আট দিন পর এমপি আনারের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।