1. [email protected] : admin :
  2. [email protected] : জাতীয় অর্থনীতি : জাতীয় অর্থনীতি
বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০১:২৫ অপরাহ্ন
শিরোনামঃ

রেমিট্যান্স পাঠানোয় নিরুৎসাহ; ক্ষতিটা দেশেরই

রিপোর্টার
  • আপডেট : শনিবার, ৩ আগস্ট, ২০২৪

আমাদের দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের প্রধান উৎস রপ্তানি খাত হলেও সার্বিক অর্থনীতিতে রেমিট্যান্সের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি কার্যকর। কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সংকটে দেশে রেমিট্যান্স পাঠানোর হার পড়ে গেছে একেবারে তলানিতে। আন্দোলনের উত্তাল সময়ে অর্থাৎ গত ১৯ থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত দেশে প্রবাসী আয় এসেছে মাত্র ৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার। অথচ চলতি মাসের প্রথম ১৮ দিনে প্রতিদিন গড়ে ৭ কোটি ৯০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলো প্রবাসীরা। কিন্তু এরপরই কোটা আন্দোলনকারীদের প্রতি সমর্থন ও সহমর্মিতার নামে প্রবাসীদের বৈধপথে রেমিট্যান্স পাঠানোয় নিরুৎসাহিত করতে উঠেপড়ে লাগে একটি মহল। মহলটি মূলত ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগকে চাপে ফেলতে এই কূটকৌশল অবলম্বন করে। কিন্তু এর নেতিবাচক প্রভাব যতোটা না আওয়ামী লীগের ওপর পড়বে, তার চেয়ে বহুগুণ বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে রাষ্ট্র।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, জুন মাসে গড়ে দৈনিক প্রবাসী আয়ের পরিমাণ ছিল আট কোটি ৪৬ লাখ ডলার। জুলাইয়ের প্রথম ১৮ দিনে সেই ধারা অব্যাহত থাকলেও ১৯ থেকে ২৪ তারিখে পর্যন্ত রেমিট্যান্স প্রবাহে চলে উল্টো হাওয়া। দেশে ইন্টারনেট সংযোগ ব্যাহত থাকাই রেমিট্যান্সের স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হবে—যেটা অস্বীকার করার জো নেই, এটা সত্য। কিন্তু এর মধ্যেই কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে একটি মহল সোচ্চার হয়ে ওঠে সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্রে। তারা মনে করে, দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে খ্যাত প্রবাসী আয় যদি বন্ধ করে দেওয়া যায়, তাহলে সরকারকে চাপে ফেলা যাবে সহজেই। কিন্তু এর মাধ্যমে যে সবচেয়ে বড় ক্ষতি দেশেরই হচ্ছে সেটা তারা বুঝতে চেষ্টা করছেন কি?

বৈধ পথে প্রবাসীদের আয় পাঠানোকে নিরুৎসাহিত করে হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাতেও উৎসাহিত করা হচ্ছে। প্রবাসীরা বৈধ পন্থার মতো অবৈধ পন্থাতেও বিদেশ থেকে স্বজনদের কাছে অর্থ পাঠান। বৈধ চ্যানেলে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠালে তা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে যোগ হয়। কিন্তু হুন্ডির মাধ্যমে পাঠালে সে অর্থ রিজার্ভে যোগ হয় না। বরং হুন্ডির মাধ্যমে দেশের টাকা পাচার হয়ে যায় বিদেশে। যার ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে।

আমরা জানি, প্রবাসে কর্মরত নাগরিকদের স্বদেশের প্রেরিত অর্থকে রেমিট্যান্স বলে। তাদের অর্জিত অর্থের একটা অংশ ব্যাংকের মাধ্যমে পরিবারের কাছে পাঠায়। এই অর্থ কেবল তাদের পরিবারের প্রয়োজনই মেটায় না, তাদের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি করে এবং নানা ক্ষেত্রে বিনিয়োগ হয়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কোনো দেশের প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্স থেকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়। অর্থনীতি বিশ্লেষকদের মতে, প্রবাসীদের কষ্টার্জিত রেমিট্যান্সের কারণেই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিশ্ব মন্দার প্রভাব তেমন একটা অনুভব হয়নি। অর্থনৈতিক গতিশীলতার ক্ষেত্রে রেমিট্যান্স গুরুত্বপূর্ণ নিউক্লিয়াস হিসাবে কাজ করে। রেমিট্যান্স আমাদের মোট অভ্যন্তরীণ আয় বা জিডিপির ৩০ থেকে ৩৫ ভাগ। জাতীয় অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি এই রেমিট্যান্স। অন্তত এক কোটি বাংলাদেশি বিদেশে কাজ করছে। তাদের পাঠানো অর্থের ওপর নির্ভর করে তাদের পরিবারের অন্তত চার কোটি সদস্য। হুট করে এভাবে যদি রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ রাখা হয়, তাহলে এই চার কোটি মানুষ কিভাবে দিনাতিপাত করবে, ওই মহলটি কি সেটা ভেবে দেখেছেন?

দেশে রেমিট্যান্স না পাঠানোর বিষয়ে সামাজিক মাধ্যমে পক্ষ-বিপক্ষ জোর প্রচারণা চলছে। প্রবাসীদের একটি গ্রুপ ছাত্র-জনতা হত্যার প্রতিবাদে ও সরকার পতনের দাবিতে রেমিট্যান্স না পাঠানোর অঙ্গীকার করে অন্যদেরকেও নিরুৎসাহিত করে প্রচারণা চালাচ্ছে। অনেকে বলছে, ব্যাংকিং চ্যানেলে নয়, টাকা পাঠাবেন হুন্ডিতে, যেখানে রেটও বেশি পাওয়া যায় আবার টাকা পাঠাতে ডিউটি বন্ধ করে ব্যাংকে যেতে হয়না, টাকা বাড়িতে গিয়ে দিয়ে আসে, আর হুন্ডিতে টাকা পাঠাতে খরচও লাগে না। একজন দলপ্রেমী না হয়ে যদি দেশপ্রেমী হিসেবে নিজেকে ভাবেন, তাহলে অবশ্যই এটা মাথায় রাখা উচিৎ হুন্ডির মাধ্যমে দেশের কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আপনারই দেশ, ক্ষতি হচ্ছে আপনারই।

তবে রেমিট্যান্স পাঠানোর পক্ষের লোকও কম নয়। সামাজিক মাধ্যমে একজন লিখেছেন, দলপ্রেমীরা কখনো রেমিট্যান্স দেশে পাঠাবে না। দেশের পরিচয় বহন করে অথচ দেশের প্রতি ভালোবাসা নেই। দেশের অর্থনীতির সমস্যা হলে সেটা আমাদের দেশের গরিব অসহায় মানুষ কষ্ট করবে..। সেটা কয়জনে বুঝে। দলকে নয় দেশে ভালোবাসি তাই আমি প্রবাসী ব্যাংকে টাকা পাঠাই। আরেকজন লিখেছেন, আমি একজন প্রবাসী আপনাদের দুঃখ আমি বুঝি। তারপর বলবো আপনারা ভুল সিদ্ধান্ত নিবেন না। এই দেশ কারো একার না এদেশ আপনার, আমার, আমাদের। যদি ভুল সিদ্ধান্ত আমরা নিই, কোন রাজনৈতিক দলের ক্ষতি হবে না ক্ষতি হবে আমাদের নিজের। তাই আসুন কারো কথাই কান না দিয়ে আমাদের দেশকে আমরা বাঁচাই।

তবে এটা অবশ্যই মনে রাখতে হবে, দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহে ব্যাঘাত ঘটলে সরকার হয়তো প্রাথমিক অবস্থায় কিছুটা চাপে পড়বে,, কিন্তু পরে এটার মাশুল আমাদের মতো সাধারণ মানুষকেই দিতে হবে। সবকিছুর দাম বেড়ে যাবে এবং সবকিছুতে সরকার ট্যাক্স বাড়িয়ে দেবে। যার প্রভাব পড়বে ওইসব প্রবাসী ভাইদের দেশে থাকা পরিবারের সদস্যদের ওপরও। প্রকৃতপক্ষে তাদের পাঠানো টাকা থেকেই অতিরিক্ত খরচের ভার বহন করতে হবে।

পরিশেষে বলবো, সব ধরনের অপপ্রচার-ষড়যন্ত্র দূরে রেখে দলমত নির্বিশেষে, সরকারের পাশাপাশি সবার উচিৎ রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের পাশে থাকা, যাদের অধিকাংশই স্বল্পশিক্ষিত। বিদেশে গিয়ে কঠোর শারীরিক পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে তারা টাকা আয় করে। নিজেদের থাকা-খাওয়ার খরচ বাদে পুরো টাকাটাই পাঠিয়ে দেয় দেশে থাকা তাদের পরিবার পরিজনের কাছে। এসব স্বল্পশিক্ষিত প্রবাসী ভাইদের মাঝে যে কোনো প্রচারণা সহজেই প্রভাব ফেলে। তাই তাদের মধ্যে নেতিবাচক নয়, বরং রেমিট্যান্সের ইতিবাচক বিষয়গুলো বেশি বেশি তুলে ধরা উচিৎ। সারা বিশ্বব্যাপী চলমান অর্থনৈতিক সংকটে বাংলাদেশ যেন পা পিছলে না পড়ে সেদিকেই সবার মনোযোগী হতে হবে। প্রবাসীদের কল্যাণে কাজ করতে হবে সবাইকে। আমাদের সবসময় এই মহান যোদ্ধাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। ওদের সহযোগিতা করা প্রয়োজন। বিদেশে যাওয়া বাবদ ব্যাংক লোন থেকে নানা সুযোগের কথা উল্লেখ থাকলেও উচ্চহারে সুদের টাকাই ওদের বড় আশ্রয়। সরকারিভাবে শ্রমিক নেওয়ার কথা থাকলেও দালালই ওদের একমাত্র মাধ্যম। শ্রমবাজারে কি সরকারিভাবে বিনিয়োগ করতে পারি না? এতে তো অন্তত সুদের টাকাটা বেঁচে যেতো। কিছু অস্বচ্ছল শ্রমিক স্বচ্ছলতার আশ্রয় পেতো। এমনকি তাদের জন্য একটি আলাদা বিমানবন্দর বা টার্মিনালের ব্যবস্থা করা উচিৎ, যেখানে শুধু এসব প্রবাসী কর্মীরাই আসা যাওয়া করবে। কারণ প্রতিবছর বিদেশে যাতায়াতকারী প্রায় অর্ধকোটি মানুষের ৬০ শতাংশই প্রবাসী। বিদেশের অ্যাম্বেসিতে যেন তারা উপযুক্ত মূল্যায়ন পায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

রেমিট্যান্স দেশের অর্থনৈতিক শক্তি। এটা নির্জীব হলে পুরো শক্তিটাই নির্জীব হয়ে যাবে। প্রবাসী রেমিট্যান্স আমাদের উন্নয়নের স্বপ্ন দেখায়। উন্নয়নের অংশীদার হয়। সেই রেমিট্যান্সকে বাধা প্রদান করলে দেশের অগ্রগতি বাধার সম্মুখীন হবে। তাই রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের নিরুৎসাহিত না করে বরং আমি, আপনি, সরকারসহ সব মহলকে সম্মিলিতভাবে ওদের উৎসাহিত করতে হবে আরও বেশি বেশি বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানোর জন্য। তবেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ইস্পাতের মতো শক্তিশালী হবে।

লেখক: মাসুদ রানা, গণমাধ্যমকর্মী।

Please Share This Post in Your Social Media

এই বিভাগের আরো সংবাদ
© ২০২০ দৈনিক জাতীয় অর্থনীতি