অপরাধের আখড়া হয়ে উঠছে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্প। নানা স্বার্থের টানাপোড়েনে ক্যাম্পকেন্দ্রিক গড়ে ওঠা অন্তত ১৫টির অধিক সশস্ত্র দল মাঝেমধ্যেই নিজেদের মধ্যে জড়িয়ে পড়ছে খুনোখুনিসহ ভয়ংকর সব অপরাধে। আগে এরা দা, ছুরি, বল্লমের মতো সাধারণ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে চলাফেরা করলেও এখন ব্যবহার করছে স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র। যদিও র্যাব-পুলিশের দাবি, সবকিছু তাদের নিয়ন্ত্রণে আছে।
কয়েক দিন ধরে টেকনাফ ও উখিয়ার এসব রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে জানা গেছে, ক্যাম্পকেন্দ্রিক ভয়ংকর সন্ত্রাসীরা মাদক-বাণিজ্য, অপহরণ আর চাঁদাবাজিতে জড়িত। ২৯ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে হত্যা করা হয়। চাঞ্চল্যকর এ হত্যার রেশ কাটতে না কাটতেই আবারও হত্যা। এবার ২৩ অক্টোবর সন্ত্রাসীরা মাদরাসায় ঢুকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে ছয়জনকে। এক মাসের ব্যবধানে নেতাসহ সাত খুন!
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব হত্যার পেছনে ইয়াবা, অস্ত্রবাণিজ্য ছাড়াও রয়েছে চাঁদা আদায়ের ঘটনা। মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবাসহ নানা প্রকার মাদক ও অস্ত্রবাণিজ্য আর সংগঠন ভিত্তিক এলাকা দখল নিয়ে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রতিনিয়ত চলছে সংঘর্ষ ও গোলাগুলি। অপহরণ, ইয়াবা বিকিকিনি এবং চাঁদাবাজি ঘিরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বেড়েছে গ্রুপিং। ক্ষমতার আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বেড়েছে খুনোখুনি।
জানা গেছে, ২০১৭ সালে সর্বশেষ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পর প্রথম বছর কিছুটা শান্ত ছিল রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো। কিন্তু বছর ঘুরতেই ক্রমে শক্তি অর্জন করে নানা অপরাধে যুক্ত হতে থাকে রোহিঙ্গারা। স্থানীয় সূত্রগুলো বলছেন, টেকনাফ ও উখিয়ার ক্যাম্পগুলোয় তৈরি হয়েছে অন্তত ১৫-এর অধিক সশস্ত্র দল। যেসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর নাম জানা গেছে তার মধ্যে উখিয়ার ক্যাম্পগুলোয় রয়েছে মুন্না গ্রুপ, আনাস গ্রুপ, মাহাদ গ্রুপ, সালাম বা সালমান শাহ গ্রুপ, হাফেজ আহমদ গ্রুপ, জহির গ্রুপ, আতাউল্লাহ গ্রুপ। টেকনাফে রয়েছে হাকিম ডাকাত গ্রুপ, নুরে আলম গ্রুপ, জকির ডাকাতের গ্রুপ।
দুই উপজেলার ক্যাম্পগুলোয় এসব গ্রুপের আড়ালে সক্রিয় রয়েছে আরসা, আল ইয়াকিন, আরাকান রোহিঙ্গা আর্মি, আতাউল্লাহর বাহিনী, আরএসও, আরআরএসও। এসব রোহিঙ্গা গ্রুপের হাতে জিম্মি সাধারণ রোহিঙ্গারা। তাদের বাইরে গেলে ঘটে অপহরণসহ হত্যা। গ্রুপগুলোর প্রতিনিয়ত গোলাগুলির ফলে সাধারণ রোহিঙ্গা ছাড়াও স্থানীয়রা রয়েছেন চরম হুমকির মুখে। ক্যাম্পসূত্র জানান, দিনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নানামুখী তৎপরতায় কিছুটা চুপচাপ থাকলেও রাতে পাল্টে যায় ক্যাম্পের দৃশ্যপট।
চাঁদা, মাদক-বাণিজ্য, চোরাচালানসহ বিভিন্ন অপরাধে যুক্ত এসব সশস্ত্র দল নিজেদের শক্তি জানান দিতে হামেশাই নির্যাতন করে সাধারণ রোহিঙ্গাদের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কুতুপালং ক্যাম্পের এক সাধারণ রোহিঙ্গা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘রাতে এখানে গ্রুপগুলো এসে আমাদের ক্যাম্পে গুলি মারে। দিনে রাতে আমাদের মারতে থাকে। আমাদের নারী-পুরুষদের পিটিয়ে সবকিছু ছিনিয়ে নিয়ে যায়।’
আরও এক রোহিঙ্গা বলেন, ‘বালুখালী ও লম্বাশিয়া ক্যাম্পে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। আমরা রাতে ঘুমাতে পারি না। আমাদের অযথা মারধর করা হয়। পালিয়ে এদিকে-ওদিক চলে যেতে হয়, রাস্তাঘাটে-ঝোপে লুকিয়ে থাকি। নিরাপত্তা বাহিনী মাঠে না থাকলে আমাদের কোনো নিরাপত্তাই নাই। জড়িত রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর সদস্যদের বিরুদ্ধে গেলেই চলে নির্যাতন।’
ক্যাম্পের একাধিক সূত্র জানান, রোহিঙ্গা শিবিরের অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা দোকানপাট থেকে চাঁদা আদায়, মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবা ও নানা প্রকার মাদক ও অস্ত্র বাণিজ্য, সংগঠনভিত্তিক এলাকা দখল নিয়ে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই প্রতিনিয়ত চলছে সংঘর্ষ ও গোলাগুলি।
স্থানীয়রা বলছেন, ক্যাম্পের অভ্যন্তরে ইয়াবা ব্যবসা, দোকান থেকে চাঁদাবাজি ও এলাকাভিত্তিক আধিপত্য বিস্তার নিয়ে রোহিঙ্গাদের একাধিক গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। এরই জেরে খুনের ঘটনা বাড়ছে।
র্যাব-১৫-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল খায়রুল ইসলাম সরকার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ক্যাম্পের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো খুব দুঃখজনক। আমরা আমাদের সামর্থ্যের সবটুকুই দিচ্ছি। তবে ক্যাম্পের ভেতরের অবস্থা ঘিঞ্জি হওয়ায় সুনির্দিষ্ট টার্গেটে অপারেশন চালাতেও বেগ পেতে হয়। অপরাধী এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকরা টের পেয়ে অবস্থান পরিবর্তন করে ফেলে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের তৎপরতা থেমে নেই। আমাদের মতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্যান্য বাহিনীর তৎপরতা ও সেনা টহল অব্যাহত রয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা শিগগিরই একটা কাঠামোর মধ্যে ক্যাম্পগুলো নিয়ে আসা সম্ভব হবে।’ উখিয়া থানার ওসি সঞ্জুর মোর্শেদ জানান, ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে কয়েকটি গ্রুপের মধ্যে উত্তেজনা চলছে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সজাগ থাকায় ক্যাম্পের পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের পাহাড়ি জমিতে ৩৪টি ক্যাম্পে আশ্রয় নেয় ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। আশ্রয় নেওয়ার পর এক বছর নীরবে রোহিঙ্গারা অতিবাহিত করলেও যত দিন যাচ্ছে ক্যাম্পগুলোয় অপরাধ বাড়ছে। স্থানীয় মাদক ও চোরাকারবারিদের সঙ্গেও তাদের অবাধ যাতায়াত। আর ক্যাম্পগুলোকে মাদক, অস্ত্রের মজুদ বানিয়ে ফেলেছে তারা। অপরাধের মাত্রা বেড়ে এখন রোহিঙ্গাদের মধ্যেই রাত হলেই সংঘর্ষ চলে।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে ১৪ এপিবিএনের অধিনায়ক নাঈমুল হক বলেন, ‘ক্যাম্পে অবস্থানরত সশস্ত্র রোহিঙ্গা গ্রুপগুলোর ব্যাপারে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। এসব গ্রুপের টাকার উৎস কোথায় তা জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে বর্তমানে ক্যাম্পের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সব রকমের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে।’