1. [email protected] : admin :
  2. [email protected] : জাতীয় অর্থনীতি : জাতীয় অর্থনীতি
শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:১৮ অপরাহ্ন

লাশের জন্য স্বজনদের অপেক্ষা, প্রস্তুত হচ্ছে কবর

অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট : শনিবার, ২৭ মার্চ, ২০২১

রাজশাহীর কাটাখালীতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১৭ জনই রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা। শুক্রবার (২৬ মার্চ) বিকেলে বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে দুর্ঘটনার খবর পেয়ে নিহতদের বাড়ি বাড়ি পড়ে কান্নার রোল। স্বজনহারাদের আর্তনাদে গ্রামে গ্রামে চলছে শোকের মাতম। যেন শোকে স্তব্ধ গোটা পীরগঞ্জ। ঘটনার একদিন পর এখন লাশের অপেক্ষায় রয়েছেন আত্মীয়-স্বজন ও গ্রামবাসী।

শনিবার (২৭ মার্চ) পৌনে ৯টার দিকে পীরগঞ্জ উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নের বড় রাজারামপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, নিহতদের স্বজনরা কবর খোঁড়াখুঁড়িতে ব্যস্ত। কেউ করছেন বাঁশ কাটাকাটি। ঘরে ঘরে চলছে কোরআন তিলাওয়াত। চারদিকে শোকাবহ পরিবেশ। লাশের অপেক্ষায় থাকা মানুষগুলোর চোখ তখনও অশ্রুসিক্ত। রাতভর আহাজারি করতে করতে এখন তারা শোক জানানোর ভাষাই হারিয়ে ফেলেছেন।

রাজশাহীর ওই দুর্ঘটনায় আগুনে পুড়ে মারা গেছেন বড় রাজারামপুর গ্রামের একই পরিবারের পাঁচজন। তারা হলেন- রড সিমেন্ট ব্যবসায়ী সালাহউদ্দিন (৩৬), তার স্ত্রী সামছুন্নাহার (২৮), ছেলে সাজিদ (৭), মেয়ে সাফা (৪) এবং সামছুন্নাহারের বড় বোন কামরুন্নাহার (৪১)। এই পরিবারের পাঁচজনের মধ্যে কামরুন্নাহারের স্বামী শাহজাহান মন্ডল তোতা ২০ বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। এরপর থেকে একমাত্র ছেলে মেহেদী হাসান তুবাকে নিয়ে বাবার বাড়িতে থাকতেন কামরুন্নাহার।

নিহত সালাহউদ্দিনের গ্রামের বাড়ি একই উপজেলার চৈত্রকোল ইউনিয়নের রাঙ্গামাটি গ্রামে। কিন্তু বিয়ের পর থেকে তিনি স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে পীরগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড এলাকায় বসবাস করে আসছিলেন।

 প্রস্তুত করা হচ্ছে কবর

কবর খোঁড়াখুঁড়ির কাজে তদারকি করার ফাঁকে কথা বলেন নিহত সালাহউদ্দিনের চাচাতো ভাই নুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, দুর্ঘটনার খবর শুনে শুক্রবার রাতে নিহতদের মরদেহ আনার জন্য তাদের পরিবারের তিনজন ইতোমধ্যে রাজশাহীতে পৌঁছেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত পাঁচজনের মধ্যে তিনজনের লাশ শনাক্ত করতে পেরেছেন তারা। বাকিদের এখনও শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। নিহতদের মরদেহ পীরগঞ্জে আসার পর জানাজার নামাজ ও দাফনের ব্যাপারে সময় নির্ধারণ করা হবে।

একই ইউনিয়নের বড় মজিদপুর গ্রামে আরও একটি পরিবারের পাঁচজন মারা গেছেন রাজশাহীর ওই দুর্ঘটনায়। সেখানকার নিহতরা হলেন- ফুল মিয়া (৪০), তার স্ত্রী নাজমা বেগম (৩৫), মেয়ে সাবিহা (৪), সুমাইয়া (৮) ও ছেলে ফয়সাল (১৩)। তারা সবাই দুর্ঘটনা কবলিত মাইক্রোবাসের ভেতরে আগুনে পুড়ে মারা গেছেন।

বাবার মৃত্যুর পর বিধবা মা সাহিদা বেগমের সঙ্গে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে নানার বাড়িতে থাকতেন ফুল মিয়া। এই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন ফুল মিয়া। কিন্তু রাজশাহীতে বেড়াতে গিয়ে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় ফুল মিয়ার সাজানো সংসার নিমিষেই শেষ হয়ে গেল। ফুল মিয়ার বৃদ্ধা মা সাহিদা বেগম বাড়িতে থাকায় দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গেছেন। সকাল ১০টার দিকে ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ফুল মিয়ার মা ও ভাইসহ আত্মীয়-স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। তাদের বুকফাটা আহাজারি দেখে গ্রামের লোকজনও কান্না করছেন।

সেখানে কথা হয় ফুল মিয়ার মামা মাদরাসাশিক্ষক আব্দুস ছালামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ফুল মিয়াকে গ্রামের সবাই খুব ভালোবাসে। সবার কাছে খুব ভালো মানুষ ছিল সে। ছোটবেলা থেকে অনেক কষ্ট করেছে। একসময় গ্রামে গ্রামে হাড়ি-পাতিল বিক্রি করেছে। অনেক কষ্টে সংসারটা গুছিয়েছিল। বৃদ্ধা মাকে সঙ্গে নিয়ে বেশ ভালোই দিন কাটছিল তার। কিন্তু কী যে হলো, একটা দুর্ঘটনায় সাজানো সংসারটা শেষ হয়ে গেল!

নিহত ফুল মিয়ার ছোট ভাই সুজন মন্ডল বলেন, বড় ভাইয়ের মৃত্যুতে আমাদের পরিবারে উপার্জনক্ষম আর কেউ থাকল না। আগে বাবাকে হারিয়েছি। ভাইকে হারিয়ে এখন সবকিছুই হারালাম। লাশ নিতে যাওয়ার মতো আমাদের কেউ নেই। গ্রামের মেম্বার রাজশাহী গেছেন। লাশ আসার পর দাফনের ব্যবস্থা হবে। এখন শুধু কবর খুঁড়ে রাখা হচ্ছে। জানাজার সময় এখনো ঠিক করা হয়নি। আমরা সবাই লাশের অপেক্ষায় আছি।

পীরগঞ্জ পৌর এলাকার প্রজাপাড়ার বাসিন্দা তাজুল করিম ভুট্টু (৪৫)। তিনি পেশায় স্যালো মেকার ছিলেন। ব্যবসায়ী বন্ধু ফুল মিয়ার আমন্ত্রণে পরিবারের সবাইকে নিয়ে তিনিও সঙ্গী হয়েছিলেন রাজশাহী ভ্রমণ যাত্রায়। কিন্তু ওই মাইক্রোবাস দুর্ঘটনায় স্ত্রী মুক্তা বেগম (৩৫) ও ছেলে ইয়াসিনসহ (১৪) মারা যান ভুট্টু। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে প্রজাপাড়ায় ভুট্টুর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় শোকে স্তব্ধ চারদিক। বাড়িতে কান্নাকাটি করার মতো কেউ নেই! পরিবারের সব সদস্যই নিহত হওয়ায় সেখানে আর কেউ নেই আহাজারি করার জন্য। বাড়িতে যারা এসেছেন সবাই দূর দূরান্তের আত্মীয় স্বজন।

ভুট্টুর মৃত্যুর খবর পেয়ে নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ থেকে সেখানে এসেছেন বড় ভাই জিয়াউল হক রানা। রানা বলেন, তাদের মা-বাবা অনেক আগেই মারা গেছেন। ভুট্টু পরিবার নিয়ে একাই প্রজাপাড়ার বাড়িতে থাকতেন। ভুট্টুর দুই ছেলের মধ্যে একজন ১০ বছর আগে পানিতে ডুবে মারা গেছে। শুক্রবার রাজশাহীতে ওই দুর্ঘটনার পর এখন ভুট্টু পরিবারের আর কেউ জীবিত নেই। লাশ শনাক্ত করতে দেরি হচ্ছে, তাই জানাজা ও দাফনের সময় নির্ধারণ করা হয়নি।

পীরগঞ্জ থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সরেস চন্দ্র বলেন, দুর্ঘটনায় নিহত ১৭ জনের মরদেহ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে রয়েছে। এদের মধ্যে ১১ জনের মরদেহ পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। নিহতদের পরিবার থেকে অনেকেই রাজশাহীতে মরদেহ গ্রহণ করতে গিয়েছেন। কিন্তু ডিএনএ নমুনা নিয়ে মরদেহ শনাক্ত করাসহ আইনি প্রক্রিয়া শেষ করতে দেরি হচ্ছে। এসব মরদেহ পীরগঞ্জে কখন আনা হবে, তা এখন বলা যাচ্ছে না।

রাজশাহী মহানগর পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের বরাত দিয়ে ওসি সরেস চন্দ্র বলেন, ওই দুর্ঘটনায় বাসচালককে আসামি করে কাটাখালী থানা পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেছেন। দুর্ঘটনার পর থেকে বাসচালক পলাতক রয়েছেন। তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চালাচ্ছে পুলিশ।

শুক্রবার (২৬ মার্চ) দুপুর পৌনে ২টার দিকে কাটাখালী থানার সামনে রাজশাহী-ঢাকা মহাসড়কে বাস-মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে মাইক্রোবাসে আগুন লেগে যায়। দুর্ঘটনার পর আটজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। এদের মধ্যে ছয়জন মারা যান। পরে আগুনে পোড়া মাইক্রোবাস থেকে নারী ও শিশুসহ আরও ১১ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া পাভেল (১৯) নামে এক মাইক্রোবাস আরোহী রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তার বাবা মোখলেছার (৪৫) ও মা পারভীন (৩৫) আগুনে পুড়ে মারা গেছেন। তারা পীরগঞ্জের রায়পুর ইউনিয়নের দ্বাড়িকাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা।

Please Share This Post in Your Social Media

এই বিভাগের আরো সংবাদ
© ২০২০ দৈনিক জাতীয় অর্থনীতি