লেখক: হাসান আলী: বিগত কয়েক দশকে অপরাধের ধরন এবং প্রকৃতি যেমন পরিবর্তিত হয়েছে, তেমনি বেড়েছে অপরাধীদের কৌশলের সূক্ষ্মতা। এখন প্রযুক্তি এবং রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে মানুষের জীবনে অদৃশ্য সন্ত্রাস সৃষ্টি করা হচ্ছে। এই নতুন কৌশলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এক অস্ত্র হলো “শয়তানের নিঃশ্বাস”, যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে “ডেভিলস ব্রেথ” নামে পরিচিত। এই মাদক শুধু ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক অবস্থা বিপর্যস্ত করে না, বরং সমাজ ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তাকে গভীর সংকটে ফেলে দেয়।
শয়তানের নিঃশ্বাস: কী এটি এবং কেন এটি এত বিপজ্জনক?
“শয়তানের নিঃশ্বাস” মূলত স্কোপোলামিন (Scopolamine) নামক একটি মাদক, যা ধুতরা গাছের বীজ এবং পাতা থেকে তৈরি। এটি দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হলেও বর্তমানে এটি অপরাধীদের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। স্কোপোলামিনের বৈশিষ্ট্য এমন যে, এটি মানুষের মস্তিষ্কে মেমোরি রিসেপ্টরগুলোর কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। ভুক্তভোগী তার স্মৃতি এবং নিজস্ব চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলে। ফলে সে যা করার জন্য নির্দেশ পায়, তা অচেতনভাবে মেনে চলে।
এই মাদকের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক হলো, এটি সম্পূর্ণভাবে গন্ধহীন এবং নির্ভুলভাবে প্রয়োগ করা যায়। অপরাধীরা এটিকে খাবার, পানীয়, ভিজিটিং কার্ড, কাগজের টুকরো এমনকি মোবাইল ফোনের স্ক্রিনের মাধ্যমে ভুক্তভোগীর শরীরে প্রবেশ করায়। একবার এটি শরীরে প্রবেশ করলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই প্রভাব শুরু হয় এবং দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করে।
বাংলাদেশে “শয়তানের নিঃশ্বাস” এর বিস্তার
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এটি অপরাধের জন্য ব্যবহৃত হলেও সম্প্রতি বাংলাদেশেও এর বিস্তার দেখা গেছে। বিশেষত জনবহুল এলাকায়, যেমন গণপরিবহন, হাট-বাজার এবং স্টেশনগুলোতে অপরাধীরা এই মাদক ব্যবহার করছে। ভুক্তভোগীরা প্রায়শই তাদের স্মৃতি হারিয়ে ফেলে এবং মূল্যবান জিনিসপত্র, অর্থ বা ব্যক্তিগত তথ্য খোয়ায়।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে জানা গেছে, অপরাধীরা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এই মাদক ব্যবহার করছে। তারা প্রথমে ভুক্তভোগীকে লক্ষ্য করে, এরপর ঘ্রাণ বা শারীরিক স্পর্শের মাধ্যমে মাদকটি প্রয়োগ করে। অনেক ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা বুঝতেও পারে না, তারা কীভাবে অপরাধের শিকার হলো।
সামাজিক এবং মানবিক প্রভাব
এই মাদকের প্রভাব শুধু ভুক্তভোগীর জীবনেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি সমগ্র সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ভুক্তভোগীরা একদিকে আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়, অন্যদিকে তারা মানসিক এবং শারীরিকভাবে গভীর আঘাতপ্রাপ্ত হয়। এই ধরনের ঘটনা মানুষের মধ্যে ভয় এবং অবিশ্বাসের জন্ম দেয়। পারস্পরিক আস্থা এবং সামাজিক বন্ধন ভেঙে পড়ে।
একইসঙ্গে, এই মাদক ব্যবহারের মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধগুলো নারী ও শিশুদের ওপর বিশেষভাবে প্রভাব ফেলে। অনেক সময় নারীদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে এবং শিশুদের ক্ষেত্রে অপহরণ বা মানবপাচারের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
আন্তর্জাতিক চিত্র
স্কোপোলামিন বা “শয়তানের নিঃশ্বাস” সর্বপ্রথম লাতিন আমেরিকায়, বিশেষত কলম্বিয়ায়, অপরাধীদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। কলম্বিয়ার অপরাধচক্র এটি ব্যবহার করে মানুষকে সম্মোহিত করে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খালি করত এবং মূল্যবান সম্পদ হাতিয়ে নিত। ধীরে ধীরে এটি ইউরোপ এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
বিশ্বব্যাপী এটি প্রতিরোধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হলেও অপরাধীদের নতুন কৌশল এবং প্রযুক্তি ব্যবহার প্রতিরোধকে কঠিন করে তুলেছে। জাতিসংঘ এবং ইন্টারপোল এই মাদক এবং এর ব্যবহারের ওপর নজর রাখলেও এটি সম্পূর্ণ নির্মূল করা সম্ভব হয়নি।
কীভাবে এ থেকে সুরক্ষা পাওয়া সম্ভব?
১. *সচেতনতা:* সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করাই এই মাদকের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অস্ত্র। অপরিচিত বা সন্দেহজনক বস্তু গ্রহণ এবং অপরিচিত ব্যক্তির কাছ থেকে ঘ্রাণ নেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
২. *আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রস্তুতি:* পুলিশ এবং অন্যান্য বাহিনীকে এই মাদক এবং এর ব্যবহার সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সুনির্দিষ্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্কোপোলামিন শনাক্ত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
৩. *কঠোর আইন প্রয়োগ:* এই মাদকের উৎপাদন, আমদানি এবং ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে কঠোর আইন প্রণয়ন এবং তার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
৪. *সামাজিক উদ্যোগ:* স্থানীয় পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সামাজিক সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।
৫. *বিকল্প প্রযুক্তির উন্নয়ন:* রাসায়নিকের প্রভাব ঠেকানোর জন্য নতুন ধরনের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে হবে।
জাতীয় অর্থনীতি এবং সামগ্রিক নিরাপত্তার ওপর প্রভাব
“শয়তানের নিঃশ্বাস” একদিকে ব্যক্তিগত সম্পদ এবং নিরাপত্তাকে বিপন্ন করছে, অন্যদিকে এটি জাতীয় অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অপরাধের হার বাড়লে বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট হয় এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সামগ্রিকভাবে, একটি নিরাপদ সমাজ নিশ্চিত করা না গেলে দেশব্যাপী অর্থনৈতিক অগ্রগতি ব্যাহত হবে। এই মাদক ব্যবহার মানুষের সামাজিক আস্থা কমিয়ে দিচ্ছে, যা সামাজিক শান্তি এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি।
পরিশেষে যা বলা যায়?
“শয়তানের নিঃশ্বাস” আজ আমাদের সমাজ এবং ব্যক্তিগত জীবনের এক নিরব ঘাতক। এটি শুধু অপরাধীদের জন্য সুবিধা নয়, এটি আমাদের মানবিক মূল্যবোধ এবং নিরাপত্তার ওপর সরাসরি আঘাত। এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শুধু সরকার বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নয়, সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।
আমরা যদি এখনই সচেতন না হই, তবে এই অদৃশ্য মাদক আমাদের সমাজকে ভেঙে দেবে। তাই সমাজ এবং রাষ্ট্রকে একত্রে কাজ করে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে “শয়তানের নিঃশ্বাস” থেকে রক্ষা করতে হবে। একমাত্র সম্মিলিত প্রচেষ্টাই এই সংকট মোকাবিলায় কার্যকর হতে পারে।