চলমান ‘লকডাউনের’ মেয়াদ আরো এক সপ্তাহ বাড়িয়ে ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত করার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে নেওয়া এই সিদ্ধান্ত অনুমোদনের জন্য গতকাল সোমবার বিকেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠানো হয়েছে। একই সঙ্গে শিগগিরই শপিং মল ও দোকানপাট খোলার বিষয়টিও সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছে সরকার। এ ছাড়া সীমিত আকারে অর্থনৈতিক কার্যাবলি চালুর বিষয়ে একাধিক জ্যেষ্ঠ সচিবও মত দিয়েছেন। বৈঠক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সরকারের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, আসছে ঈদ উপলক্ষে দোকান মালিক এবং কর্মচারীসহ সামগ্রিক অর্থনীতির বিষয়টি মাথায় রেখে আগামী রবিবারের দিকে দোকানপাট খুলে দেওয়া হতে পারে। তবে স্বাস্থ্যবিধি যাতে কঠোরভাবে মানা হয়, সেদিকে বিশেষ নজর রাখা হবে।
মন্ত্রিপরিষদসচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের সভাপতিত্বে উচ্চ পর্যায়ের ওই বৈঠক হয়। জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদসচিব বলেন, বৈঠকে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত এলে জানতে পারবেন।
বৈঠক সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস এবং অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব আবদুর রউফ তালুকদার মানুষের জীবন-জীবিকার স্বার্থে অর্থনীতির চাকা কিছুটা হলেও সচল করা দরকার বলে মত প্রকাশ করেন। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব নজরুল ইসলাম পরিবহন শ্রমিকদের বিষয়টাও মানবিক দিক থেকে বিবেচনা করা দরকার বলে মত প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোকাম্মেল হোসেন চীনের গুয়াংজু প্রদেশের সঙ্গে বিমান যোগাযোগ চালুর প্রস্তাব করেন। এই প্রস্তাব সমর্থন করেন সিভিল এভিয়েশন প্রতিনিধি। গতকালের বৈঠকে উপস্থিত একাধিক সূত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা এসব তথ্য নিশ্চিত করে।
দোকানপাট খুললেই গণপরিবহনের প্রশ্ন আসে। এ বিষয়ে দায়িত্বশীল সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, আপাতত এক সপ্তাহের লকডাউন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত আদেশ আকারে জারি হবে। এরপর এ সপ্তাহের শেষ দিকে অর্থাৎ বৃহস্পতিবারের দিকে আবার একটি সম্পূরক আদেশ হতে পারে, যাতে দোকানপাট খোলার সিদ্ধান্ত হতে পারে। তবে এর আগেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে দোকান-শপিং মল খুলতে একটি স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) তৈরি করতে বলা হয়েছে, যাতে কভিডের সময়ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে মানুষ শপিং মলে যেতে পারে।
বৈঠক সূত্র জানায়, চলমান লকডাউনে বিভিন্ন জায়গায় মোবাইল কোর্ট ও পুলিশের সঙ্গে হওয়া সমস্যা নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের ধৈর্য ও সহযোগিতা কামনা করেন পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ। এ সময় গত রবিবার রাজধানীতে এক নারী চিকিৎসকের সঙ্গে পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটের বিতণ্ডার বিষয়টিও আলোচনা হয়। এই পর্যায়ে মন্ত্রিপরিষদসচিব আইজিপিকে এ বিষয়ে বৈঠকে কথা না বলে উনার সঙ্গে একান্তে কথা বলার পরামর্শ দেন। এরপর বৈঠকে আর এ বিষয়ে কথা হয়নি। তবে সব সরকারি কর্মচারী যেন নিজ নিজ পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখেন, সেই নির্দেশনা দেন মন্ত্রিপরিষদসচিব।
বৈঠকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে চলমান লকডাউনের সঙ্গে আরো অন্তত দুই সপ্তাহের লকডাউন চালুর বিষয়ে প্রস্তাব রাখা হয়। সেই সঙ্গে ইফতারের সময় বিভিন্ন দোকানে যেভাবে ভিড় হচ্ছে, তার মাধ্যমে কভিড ছড়ানোর আশঙ্কা প্রকাশ করেন আইইডিসিআরের একজন পরিচালক। তখন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব প্রশ্ন তোলেন, এর কোনো সমীক্ষা আছে কি না। জবাবে আইইডিসিআর কর্মকর্তা জানান, এ বিষয়ে কোনো সমীক্ষা নেই, এটা তাঁদের আশঙ্কা।
বৈঠক সূত্র জানায়, ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর নেতারা উপস্থিত ছিলেন। এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম বলেন, এক সপ্তাহ লকডাউন বাড়ানো যায়; কিন্তু পর্যায়ক্রমে লকডাউনের কড়াকড়ি কমানোর পরামর্শ দেন তিনি। একই সুরে কথা বলেন অন্য দুই নেতাও। তবে বিকেএমইএর সভাপতি সেলিম ওসমান বলেন, পাড়া-মহল্লায় প্রচুর মানুষের ভিড় হচ্ছে। এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে মন্ত্রিপরিষদসচিব বলেন, অনেক কারখানায় শ্রমিকদের দূর থেকে আসতে হচ্ছে। এসব বিষয়ে কারখানাগুলো যেন আরো ভালো পদক্ষেপ নেয়।
এদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও ঈদের আগে লকডাউন শিথিলে সরকারের ভাবনার কথা জানিয়েছেন গণমাধ্যমে। গতকাল ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে সরকার ঈদের আগে লকডাউন শিথিলের চিন্তা-ভাবনা করছে। ঈদের সময় ঘরমুখো মানুষের যাতায়াতের জন্য লকডাউন শিথিল হতে পারে। মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকুন ও ধৈর্য ধরুন।
করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি রোধে দ্বিতীয় ধাপের প্রথম চেষ্টায় ৫-১১ এপ্রিল কিছুটা কড়াকড়ির চেষ্টা করলেও কার্যত তাতে সফলতা আসেনি। এরপর ১৪ এপ্রিল থেকে দেশে শিল্পপ্রতিষ্ঠান খোলা রেখে ‘কঠোর লকডাউন’ ঘোষণা করা হয়। আগামীকাল বুধবার রাত ১২টা পর্যন্ত এর মেয়াদ রয়েছে। অন্যদিকে গত রবিবার রাতে কভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির ৩১তম সভা থেকে কঠোর লকডাউন আরো দুই সপ্তাহ বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনও গতকাল এ বিষয়ে কথা বলেছেন। তিনি জানান, একই শর্তে চলমান লকডাউনের মেয়াদ আরো এক সপ্তাহ বাড়ছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে, আগামী ২২ থেকে ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত আগের শর্ত মেনে লকডাউন চালানো হবে।